তিন বছর পর হিথক্লিফ ফিরে এলো। তার এখন অর্থের অভাব নেই। আর আছে মাথাভর্তি পরিকল্পনা ও সাপের মতোই কুটিল বুদ্ধি। ক্যাথারিন যখন পাশে ছিল, হিথক্লিফ ছিল কপর্দকশূন্য। কিন্তু তখন সে ছিল সৎ, পরিশ্রমী ও সহনশীল। হিন্ডলের অমানবিক ব্যবহার নীরবে সহ্য করতো। এখন সে ধনী। অথচ, ক্যাথারিন তার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। সে এখন ভণ্ড, অধৈর্য, স্বার্থপর ও প্রতিশোধপারায়ণ।
সম্ভবত, ক্যাথারিনের সঙ্গে বাস্তবে তার মিলনের অসম্ভাব্যতাই তার প্রচণ্ড শক্তিকে জাগিয়ে দিল। হিথক্লিফ বুঝলো, ঈশ্বর অনেক বেশি নিষ্ঠুর। তুলনায়, শয়তানের করুণা অনেক দ্রুত ও সহজে পাওয়া যায়। সে তার ভালোবাসার জন্য শয়তানের কাছে সাহায্য চাইলো। কিন্তু শয়তান তার সঙ্গে ছলনা করলো। প্রচুর অর্থ হাতে পেয়ে সে ভাবলো, শয়তান তাকে আশীর্বাদ করেছে। সে ভুলে গেল, আশীর্বাদ করতে শয়তান অক্ষম, সে কেবল অভিশাপই দিতে পারে। তিনবছর পর ফিরে এসে হিথক্লিফ সেই অভিশাপের প্রথম চিহ্নটিকেই প্রত্যক্ষ করলো।
হিথক্লিফ দেখলো, ক্যাথরিন বিবাহিত। এ জীবনে তাকে ফিরে পাবার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। অতএব মনে মনে সে ক্যাথরিনের মৃত্যুকামনা করতে শুরু করলো। হিথক্লিফকে দেখে ক্যাথরিনের মনেও জেগে উঠলো অতৃপ্ত আকাঙ্খা। সে বুঝতে পারলো। এডগারকে সে ভালোবাসে না। অথচ তার সঙ্গেই কাটাতে হবে সারাটা জীবন। যাকে সে ভালোবাসে, সেই হিথক্লিফ তার চোখের সামনে ঘুরেফিরে বেড়াবে, অথচ কোনওদিন তাদের মিলন হবে না। তাছাড়া যে কারণে হিথক্লইফকে সে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই কারণটিও আর কোনও গুরুত্ব নেই। হিথক্লিফ এখন ধনী। সামাজিকভাবেও যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী। অতএব, হিথক্লিফের উপস্থিতিই ক্যাথারিনের জীবনের আপাত শান্তিকে তছনছ করে দিয়ে সেখানে এক অনিবার্য ধ্বংসের গোপন ইশারাকে প্রোথিত করলো। একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে শুরু করলো ক্যাথারিন।
কিন্তু দ্রুত হিথক্লিফ বুঝতে পারলো, ক্যাথারিনের মৃত্যুর জন্য তার উপস্থিতিই যথেষ্ট নয়। উপস্থিতির পাশাপাশি প্রয়োজন তার অনুপস্থিতিও। আর লিনটন পরিবারে নিজেকে গরহাজির রাখতে গেলে সর্বপ্রথম এডগারকে চটানো দরকার। সে প্রকাশ্যেই এডগারের বোন ইসাবেলার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় শুরু করলো। ইসাবেলাও উন্মাদ হয়ে গেল তার প্রতি। এডগারকে সে বাধ্য করলো ক্যাথারিনের সামনে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে। এই ঘটনায় ক্যাথারিন প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লো। যাকে সে ভালোবাসে, তাকে দেখতে পারছে না এমন একজনের জন্য যাকে সে ভালোবাসে না। এডগারকে সে ঘৃণা করতে শুরু করলো। হিথক্লিফের প্রতি দ্বিগুনিত হয়ে উঠলো তার প্রচণ্ড প্রেম।
অসুস্থ ক্যাথারিনকে সেবাশুশ্রূষা করে এডগারই সুস্থ করে তুললো। এডগারের এই সময়কার আচরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় মাদাম বোভারির অসুস্থতার সময় শার্ল বোভারির একনিষ্ঠ সেবাকে। হিথক্লিফ বুঝতে পারলো, ক্যাথারিনের মনের পুরনো আঘাতকে খুচিয়ে তুলতে না পারলে তার মৃত্যু হবে না। সে আবার ক্যাথারিনের সঙ্গে দেখা করলো। সবে সুস্থ ক্যাথারিনের মনে দেখা দিল প্রচণ্ড স্নায়ুবিক্ষোভ। তার মনে পুরনো আঘাতের স্মৃতি জেগে উঠলো। হিথক্লিফকে আবার হারাতে হবে ভেবে একদিকে সে যেমন প্রচণ্ড ভয় পেল, তেমনই এই বঞ্চিত প্রেমিকটির জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠলো তার করুণা ও প্রেম। ভবিষ্যতের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে সে আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। ক্যাথারিনের মৃত্যু হলো সেদিন রাতেই। হিথক্লিফ যা চাইছিল তাই পেল। ক্যাথরিনকে না পাওয়া ও চোখের সামনে তাকে অন্যের সংসার করতে দেখার যন্ত্রণা থেকে সে মুক্তি পেল। হিথক্লিফ নিজেও জানতো না, ক্যাথারিনের বেঁচে থাকাই ছিল তার কাছে শেষ সুযোগটুকু। ক্যাথারিনের মৃত্যু হিথক্লিফকে পুরোপুরি ও চিরতরে শয়তানের ক্রিতদাস বানিয়ে দিল।
ক্যাথারিনের মৃত্যুদৃশ্যে ওদের দু’জনকেই ‘অদ্ভুত আর ভয়ংকর’ মনে হয়। হিথক্লিফ সগর্বে ঘোষণা করে, ‘ভগবান বা শয়তান-যে কোনও শাস্তির ব্যবস্থাই করুক না কেন, কেউই বা কোনও কিছুই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারতো না।’ পরেও হিথক্লিফের মনে হয়েছে, ‘একদিন ও বেঁচেছিল এবং আমি ওকে হারিয়েছি – সারা দুনিয়াটাই ওর স্মৃতির এক ভয়াবহ সংগ্রহশালা।’ মৃত্যুর ঠিক আগে ক্যাথারিনকে সে শুনিয়ে দেয়, ‘তুমি যখন শান্তিতে থাকবে, আমি তখন অশেষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করবো-তোমার পৈশাচিক স্বার্থপরতার জন্য এটাই কি যথেষ্ট নয়?’
ক্যাথারিনের মৃত্যুর পর এডগারের জীবন সম্পূর্ণ পালটে যায়। জীবন সম্পর্কে সে নির্মোহ হয়ে ওঠে। সন্ন্যাসীর মত দিন কাটায়। যত্নে, স্নেহে একমাত্র মেয়ে ক্যাথারিন লিটটনকে মানুষ করে। এ যেন আরেক শার্ল বোভারির কাহিনী। ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে অনুগতের মতো সে প্রকৃত সাহসের পরিচয় দেয়। কিন্তু, পত্নীবিয়োগের পর হিণ্ডলে আর্নশ’র পরিণত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঈশ্বরের ওপর তার সমস্ত ভক্তিশ্রদ্ধা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অন্ধের মতো সে শয়তানকে বিশ্বাস করে বসে। একমাত্র ছেলে হেয়ারটন আর্নশের ভবিষ্যতকে নিজের হাতে বন্ধক রেখে যায় হিথক্লিফের কাছে। সে যখন মারা যায়, তার জমিদারির প্রতিটি ইঞ্চি তখন হিথক্লিফের কাছে বাধা। হিণ্ডলে ঈশ্বরের ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। সে একথাও বলেছিল, ‘যে সৃষ্টিকর্তা এই আত্মার সৃষ্টি করেছে সেই ব্যাটাকে শাস্তি দিতে আত্মাকে নরকে পাঠাবো।’ নিজের আত্মাকে নরকে পাঠিয়ে সে চেয়েছিল আত্মার স্রষ্টাকে যন্ত্রণা দিতে।
হিথক্লিফও ঠিক তাই চেয়েছিল। যে ভাগ্য তার সঙ্গে কেবল বিমাতৃসুলভ ব্যবহারই করে এসেছে, তাকে সে শাসন করতে চাইল। স্মৃতির ভয়াবহ সংগ্রহশালার প্রতিটি সংগ্রহকে সে ঘৃণা করে। তাদের নিশ্চিহ্ন করে প্রতিটি সংগ্রহকে হত্যা করার অর্থ, নিজেকে ও নিজের ভেতর বেঁচে থাকা ক্যাথারিনকে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। মৃত্যুর ঠিক আগে হিথক্লিফ তাই বলে, ‘এ এক অদ্ভুত ধরনের হত্যা। ইঞ্চি ইঞ্চি করে নয়, তিল তিল করে মারা। আঠারো বছর ধরে কুহকী আশা আমার সঙ্গে ছলনার খেলা খেলে চলেছে।’ সে আরও বলে, ‘হা ঈশ্বর! কি সুদীর্ঘ এই সংগ্রাম! এই যুদ্ধ শেষ হলেই বাঁচতাম!’
হিথক্লিফের যুদ্ধ শুরু হয় ক্যাথারিনের মৃত্যুর আগেই। ইসাবেলাকে প্রেমের অভিনয় করে সে বিয়ে করে। এডগারের সঙ্গে তার বোনের চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিয়ের পর সে চরম অত্যাচার শুরু করে ইসাবেলার ওপর। ইসাবেলা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করে। ইসাবেলার মৃত্যুর পর তার একমাত্র সন্তান লিনটনকে থ্রাসক্রস গ্র্যাঞ্জে নিয়ে এলো এডগার। কিন্তু পরদিনই হিথক্লিফ সবার অনিচ্ছায় তাকে নিজের কাছে নিয়ে গেল। হিথক্লিফের ইচ্ছা, লিনটনের সঙ্গে সে ক্যাথারিনের বিয়ে দেয়। ক্যাথারিনকে সে ক্রমাগত প্ররোচিত করতে থাকে। এডগারের প্রচণ্ড অসুস্থতার সময় ক্যাথারিনকে ভুলিয়ে নিয়ে এসে জোর করে সে লিনটনের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। ক্যাথারিনকে না দেখে এডগারের অসুস্থতা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। হিথক্লিফ তার সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে পারে এই ভয়ে এডগার মৃত্যুর ঠিক আগে অ্যাটর্নি মিঃ গ্রিনকে ডেকে পাঠায়। কিন্তু মিঃ গ্রিন আসে এডগারের মৃত্যুর পরদিন সকালে। থ্রাসক্রস গ্র্যাঞ্জের মালিক হয়ে বসে হিথক্লিফ। কিছুদিন পর রোগে ভুগে বিনা চিকিৎসায় লিনটনের মৃত্যু হয়। ক্যাথারিনের শত অনুরোধেও হিথক্লিফ ডাক্তার কেনেথকে খবর দেয় না। নিজের ছেলেকে চোখের সামনে মরতে দেখে।
এইভাবে স্বামী ও স্ত্রী, সন্তান ও পিতা বা মাতা, ভাই ও বোন, জমি ও জমির মালিক, পাশাপাশি দুটি জমিদারিতে যেন এক সর্বব্যাপী ঘৃণা ও বিচ্ছেদ নিয়ে আসে হিথক্লিফ। মানবিক সম্পর্ক ও জাগতিক নিয়মকানুনগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠা হয় এক বীভৎস অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার। সৃষ্টির আগের সময়ের সেই নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি যেন ফিরে আসে। আর শয়তানের এই রাজত্ব ফিরিয়ে আনতে হিথক্লিফ ব্যবহার করে দুটি অস্ত্র। কুটিল বুদ্ধি ও অপর্যাপ্ত অর্থ। বুদ্ধি থেকে আসে পরিকল্পনা ও তাকে কার্যকারী করে তোলার উপায়। অর্থ দিয়ে পরিকল্পনা সফল করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় মানুষ কেনা যায়।
ক্রমশ প্রকাশ্য...