যুগলপ্রসাদকে মনে আছে?
আরণ্যক উপন্যাসের সেই ভবঘুরে চরিত্র, যে মানুষটি পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, লছমীপুরের জঙ্গলে বুনো ফুলের চারা আর বনের লতা এনে লাগাত লবটুলিয়া বইহারের মাটিতে। যে নাম না-জানা ফুল, ফল, বুনো ঔষধির বীজ খুঁজে এনে রোপণ করত নাঢ়া বইহারের পাথুরে জমিতে। আশায় থাকত এক দিন সে সব গাছ, লতা, বনৌষধির সবুজ প্রাণ মাথা তুলবে মাটির উপরে। অযত্নে ও আপন খেয়ালে বেড়ে উঠবে। মহীরুহের পাতা-ফুল-বীজ ভাসবে বাতাসে। ছুঁতে চাইবে আকাশের নীলিমাকে। যুগলপ্রসাদ এ সব কাজ করত মানুষের চোখের আড়ালে। তাঁরই একান্ত আবেগতাড়িত মনের খোরাক। সবুজের ধ্বংস দেখলে তার দু-চোখে নামত জলধারা। নাঢ়া বইহারের আর সরস্বতীকুন্ডির মাটিতে সে ফুটিয়ে চলেছিল শত শত জংলি ফুল… ।
পড়েছি কাঁকরাঝোরার প্রেমে। সঙ্গী ক্যামেরার ঝোলা। পুঁজি বলতে হরি-মটর। পৌষের হাড়-কাঁপানো শীতের কুয়াশা ঠেলে ঝাড়গ্রামে নেমে পথের খোঁজ করতেই পিলে-চমকানো হেঁচকি উঠল। মধ্যবিত্ত সাবধান। ও পথে বাস চলে না। গাড়ি ভাড়ার নামে গাড়ির মালিকেরা ট্যুরিস্টের পকেটে ক্ষুর চালায়, প্রকাশ্যেই। এখানে আসা ভ্রমণার্থীরা বাস্তবে বেসরকারি গাড়ি-চালকদের মুরগিবিশেষ।
ভাড়ার হাঁকডাক শুনে বড় দুঃখেও হাসি পায়। বিকল্প তখনকার হাড়-জিরজিরে লগবগে বাসে চেপে প্রবল ভিড়ে হাড়গোড় গুঁজে হাড়-হাভাতে ভ্রমণ। মাত্র ৪২ কিমি পথ পার হতে দুটি ঘণ্টার নির্মম অগস্ত্যযাত্রা। বেলপাহাড়ি থেকে পাথরকুচির ট্রাকে ভুলাভেদা। তারপর আরণ্যক চড়াইপথ মাত্র ১৬ কিমি।
জমির আল ডিঙিয়ে রাঙামাটির চড়াই ভেঙে বনদপ্তরের অফিস ডাইনে রেখে ঢুকে পড়লাম শাল বনে। একলা চলতে হয়। দিনের আলো নিভতে দেরি আছে অনেক।
স্বপ্ন বড় মধুর। চোখ খুলতেই ম্যালেরিয়ার কাঁপুনি। আমার নাক বরাবর ঝুলে আছে একটি প্রায় দানবীয় মুখ। মাথাভর্তি টাক। তার ওপরে কাত হয়ে হনুমান টুপি। ডান হাতে একটা ধারালো হাঁসুয়া। আমি ভুমিশয্যায় শুয়ে প্রবল আতঙ্কিত। পরক্ষনেই বোমারু বিমানের শব্দ ছাপিয়ে প্রাণখোলা এক হাসির দমক। আওয়াজে পাশের লাটা ঝোপ থেকে দিগন্তের দিকে উড়ে পালায় এক ঝাঁক মুনিয়া। এক জোড়া বুনো খরগোশ নির্জনে প্রেমালাপ করছিল, তারাও চমকে উঠে ছুট লাগাল কুরচি বনের গভীরে। হাসি বড় ছোঁয়াচে। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো আমারও দু-ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ছড়ায়।
হাঁসুয়া ব্যাগে ভরে ধপাস করে পাশে বসে পড়ে আগন্তুক। তখনও শব্দ ছড়িয়ে হা-হা হো-হো করে হাসছে। বলে- “মহাশয় কি লেখক নাকি? এ পথে তো লেখক আর পাগল ছাড়া কেউ হাঁটে না। তাই জিজ্ঞেস করছি। কী, ঠিক বলেছি তো?”
“ওই এক রকম আর কী। আসলে …” আমার কথা কেড়ে নিয়ে ও বলে-
“আসলে এ-ই অনেক কিছু। ইয়া-ইয়া সব নাম। কাগজ-কলম, মেশিনগান দু-বেলা ঘরে ঝগড়াঝাঁটি। ঠা-ঠা-ঠা-ঠা …। অন্য কোনো কাজ জুটল না? নেহাতই বেকার না হলে কেউ লেখক হয় নাকি? বুঝলে কিছু?”
“না, ঠিক বুঝলাম না।” বলি আমি।
“মগজের জন্য লেখা। লেখার জন্য পড়া। বই-খাতা, কাগজ-কলম। তারপরে ছাপাখানা, মলাট, বোর্ড-বাঁধাই, পেপারব্যাক, তুলি। কমার্শিয়াল আর্ট এজেন্সি, বইমেলা, খরিদ্দার, পাঠক … কত্ত হ্যাপা। তায় বাপু ওই লেখক আর পাঠক হল নিপাট গর্দভ। বাকি সবাই মাঝপথে ব্যবসা করে। পুঁজি কামায়। প্রথম আর শেষ দু-জনই গর্দভ। যে লেখে, সে না-খেয়ে মরে। আর যে গাঁটের কড়ি খরচ করে বই কেনে, বুদ্ধিমান লোক তাকে পাগল বলে। চালাক মানুষ ও সবে নেই। তারা হয় আমলা, না-হয় প্রোমোটার কিম্বা ঠিকাদার। আজকের দিনে পঞ্চুর নেতা হওয়ায় অবশ্য লাভ বেশি। লিডার বটে। তোমরা হলে গিয়ে গবেট। সব লেখকই হল এক ধরনের উজবুকবিশেষ। আমি বলি না। আমার ছোট বউমা আমার ছোট ভাই, মানে তার পতিদেবতাকে রোজই এ সব বলে গাল দেয়। কী, বুঝলে কিছু?”
“এক বর্ণও না। এক মিলিমিটারও মগজে ঢোকেনি।”
“কিছুই বোঝ না হে তোমরা। অথচ হাজার হাজার মানুষকে বোঝাতে যাও। সব আহাম্মকের দল। তোমরা সবাই হলে গিয়ে থার্ড ক্লাস সিটিজেন।” –বলে আবার উদাত্ত হাসি।
“তা হলে ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন কারা হল দাদা?” বলি আমি।
“তা-ও জান না বাপু? এ দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক হল ঠিকাদার, দালাল, প্রোমোটার আর ওই খদ্দরের দোকানিরা। এই নাও হে, বরং পাউরুটি খাও।”
রাগ হলেও প্রতিবাদ করার দুঃসাহস আমার নেই। ওই হেঁসোর একটি কোপেই আমার মুণ্ডুটি ধড় থেকে পৃথক হয়ে যেতে পারে। বিরক্তি চেপে আমি একটু পরে প্রশ্ন করি-
“আমি না হয় উজবুক, কিন্তু আপনার পরিচয়টা তো জানা হল না স্যার।”
“অ, বলিনি বুঝি। আমি অবশ্য তোমার মতো বুদ্ধিবিছুটি নয়। বেশি বকবক করি বলে আমার গৃহিণী আমাকে বিশ্ববখাটে বলে।”
“না-না তা হবেন কেন? তবে কীনা …”
“আমি ললিত বেরা। আমলাদের লেজুড়। সরকারি চাকুরে। এই তামাম ফরেস্ট বিটের মালিক আমি। ডেপুটি রেঞ্জার। ভোলে বাবা পার করেগা।” নিজের রসিকতায় হাসছে নিজেই। চোখ পিটপিট করছে আর পরম তৃপ্তিতে শুকনো পাউরুটি চিবোচ্ছে তারিয়ে তারিয়ে। আমি ভাবি এই উদ্ভট অরণ্যরক্ষকের কাঁধে যদি তক্ষকের মতো ভর করতে পারি তা হলে এ যাত্রায় আমার পদযুগল কিছুটা বিশ্রাম পাবে। সে কথা বলার আগেই ললিত বলে ওঠে-
“নাও হে, উঠে পড়ো। বেলা পড়তে আর বেশি দেরি নেই। তুমি বেয়ারফুট লেখক আমি বেয়ারফুট ফরেস্টার।”
ক্রমশ প্রকাশ্য...