অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ২

দু-রে-র দিগন্তরেখায় ছায়া নামছে। নিবিড় শাল-মহুলের ফাঁক দিয়ে দিনমণির রথচক্র দিগন্তরেখার অনেক ওপরে প্রায় অস্তাচলগামী। গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়েছি প্রায় দু-ঘণ্টা।

ললিতদা আমারই মতো পদযাত্রী। ভরসা একটাই, এই মরা বেলায় অরণ্যপথে পথ হারাতে হবে না। বড় সহজ সরল মানুষ এরা। মেকি ভদ্রতার ধার ধারে না। যা বলার মুখের ওপর বলে দেয়। পথের বাঁকে ছড়িয়ে থাকা গাছ, লতা, ঘাষ, বুনো ফুল ধরে ধরে বিবরণ দিয়ে চলেছে। আউড়ে যাচ্ছে তাদের চলতি নাম, বিজ্ঞানসম্মত নাম, ঔষধগুণ – যেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের বিশ্বকোষ। ছড়িয়ে-থাকা পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে ওস্তাদ ভুবিজ্ঞানীর মতো তাদের নাম, ধাম, বংশগরিমা, কী কাজে লাগে তা বুঝিয়ে দিয়ে কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে খাদে আবার কাউকে ভরছে নিজের ব্যাগে। এ যেন আপন খেয়ালে গড়া আর ভাঙার তামাশা! এই মানুষ বলে কিনা পড়াশুনা করা আহাম্মকি! পড়ুয়া আর লেখকেরা নির্বোধ! কেতাবি জ্ঞান তো বটেই বহু দশকের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নীরব অরন্যসাধক এই ললিত। বরাতজোরে এদের সান্নিধ্য জোটে। হাঁটার গতি পাহাড়ে যেমন হয়। স্লো বাট স্টেডি। পায়ে পায়ে উড়ছে ঝাঁক বেঁধে ঘাসফড়িং, তাদের পিছনে পাখির ঝাঁক। কেউ খাদ্য, কেউ-বা খাদক। ললিতদা হাঁটছে চড়াই-উতরাই ভেঙে। শর্টকাট জার্নি। হাঁটছে, কিছুক্ষণ পরেই বসে পড়ে কিছু যেন কাজ করছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম ওর ব্যাগে আছে একটা খুদে শাবল আর হাতে দাওলি। ছোট ছোট কাগজের প্যাকেটে হরেক রকম গাছের বীজ। মাটি খুঁড়ে নিরাপদ স্থানে সেই বীজ ললিতদা বপন করে চলেছে অবিরাম।

বিভূতিভূষণের আরণ্যকের যুগলপ্রসাদ আমারই পাশে। মনের গহনে সন্দেহের কাঁটা – প্রেতাত্মা নয় তো? এ-ও কি সম্ভব? এই জেট যুগের ভয়ানক স্বার্থান্বেষী মানুষের মিছিলে সেই আদি আরণ্যক মানবের সান্নিধ্য। নিজের চর্মচক্ষুকে অবিশ্বাস করি কী ভাবে? বলি –

rangamati_02

শিল্পীঃ সুদীপ চক্রবর্তী

“কী বীজ পুঁতলে ললিতদা?”

“দেখে ফেললে হে লেখক! তোমাদের চোখ এড়ানোর উপায় নেই হে। খয়ের গাছ হে, যে বস্তু পানে খায় বাবুরা। আসলে কী জান বাপু এ সব কাজ আইনের চোখে অপরাধ।”

“অপরাধ হবে কেন? তুমি তো অন্যায় কিছু করছ না।”

“ন্যায় অন্যায় হুজুরেরা বোঝেন। আমরা সরকারি মজুর। চাকরি করি তাই চাকরবিশেষ হে। এখন যা করছি তাতে ওপরওলার অনুমতি নেই। জঙ্গল হল সরকারি সম্পত্তি, কেউ লুঠ করলে বা গাছ কেটে সাফ করে দিলে দোষের হয় না। কিন্তু স্কিমের বাইরে গাছ লাগানো বেআইনি। অফ দ্য রেকর্ড। লিখে দিও না যেন। অন্তত যত দিন চাকরিতে আছি তত দিন লিখো না হে! ওপরওলার গোঁসা হলে চার্জশিট খেতে হবে।”

“তা যখন জানাই, তখন এ কাজ কর কেন? পরিশ্রমও আছে, খরচও আছে। আবার শাস্তির ভয় তো আছেই।”

“নেশা হে লেখক, নেশা। এই বনে খয়ের গাছ নেই। উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে নাথুয়াতে প্রচুর আছে। বীজ এনেছি নাথুয়া থেকেই। এখানেও ছিল এক সময়ে প্রচুর খয়ের গাছ। পরিহাটির কিছু দূরে বিহারের পাহাড়ি জঙ্গলে খয়েরবনি নামে একটা গ্রাম আছে। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু গাছ আজও বেঁচে আছে।”

“তা এখানে যে এখনও খয়ের গাছ আছে, লাগালে এখনও খয়ের গাছের জঙ্গল গড়ে তোলা যায়, এ সব কথা জানিয়েছ ওপরমহলকে?”

“একশোখানা চিঠি লিখেছি। সাহেবের মত আছে, তাই তো বেআইনি জেনেও লাগাচ্ছি। উত্তরবঙ্গে যাওয়া-আসা, বীজসংগ্রহ – সব খরচই সাহেব দিয়েছেন পকেট থেকে। তবুও এ সব বেআইনি। কারণ ইউনিয়ন এ সব করতে দেবে না। নেতারা বলেছে কাজ বাড়ানো চলবে না। আচ্ছা তুমিই বলো তো হে লেখক, কাজ কি কখনও কমে? কাজ করে যাও, কাজ তো তোমার বেড়েই চলবে গো।”

“আসলে ওই নেতারা কাজকে ভয় পায়। তাই কাজে বাধা দেয় ওরা।”

“ডি-গ্রুপ ইউনিয়ন গো, নেতারা সব সাহেবদের পা ধরে চাকরি পেয়েছিল। এখন ওরাই সাহেবকে মারতে যায়। বলে কীনা ও সব সাহেবটাহেব ওরা বোঝে না, সব সাহেবরই লাশ হজম করে দেব। সে যাক বাপু, এই যে নদী দেখছ এর নাম কঙ্করঝোরা। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে নুড়ি, পাথর, কাঁকর ঝরে এই নদীতে। এই চারপাশের পাহাড়গুলির নাম দুলকি ঘুরপাহাড়ি। এর পিছনে আছে লাকাইসিনি। তার পূর্বদিকে পাবে ঝালিয়া আর ময়ূর পাহাড়। তাদের পুবে সেই ঘাটশিলার বুরুডি পাহাড়ের পিছনে আছে সাদা পাহাড়। নাম সিংবুরু, স্বয়ং মহাদেব পশুপতির নিবাস, ওখানে তাই শিকার করা মানা। কঙ্কারঝোরা, ভৈরোবাঁকি, খরসোতি, শিলাই এ সব নদীর জন্ম এই হিল-রেনজ থেকেই। যেমন তোমাদের ডুলুং নদী জানো সে কথা? সেই ডুলুং জন্মেছে ডুলুং ডিহা মৌজা থেকে।”

“শুনেছি, বিডিও শান্তিদা বলেছিলেন। চেন শান্তিবাবুকে?”

“চিনব না? কত বড় মানুষ। কবি বটে। আর সেই কারণেই তো সাহেব হতে পারেননি। নইলে কবে উনি জেলার বড়কর্তা হয়ে যেতেন।”

“কিন্তু তোমার ডুলুং ডিহার কথা কী যেন বলছিলে?”

“ডুলুং তো হালের নাম। এর আসল নাম হল দোলনা। মৌজাটার নাম ছিল ‘দোলন দিয়া’। সাহেব-আমলের সার্ভের সময়ে ওই রেভনিউ দপ্তরের কোনো এক বড়বাবুর কলমের খোঁচায় দোলন দিয়া হয়ে গেল ডুলং ডিহা। আর নদীর নামটাও বদলে গেল— ডুলুং। সরকারি অফিসে ওই বড়বাবুরাই তো কর্তাঠাকুর গো। বড়বাবু নোট না দিলে ফাইল নড়ে না। তা আমরা হেড-আপিসের বললেন, এ সব বাজে প্রস্তাব। হবেক নাই।”

“বাজে প্রস্তাব আবার কী হল?”

“খয়ের গাছ গো। আমি খয়েরবনির কথা বলায় সাহেব বললেন লিখিত প্রস্তাব জমা দিতে। তা দিলাম লিখিত রিপোর্ট। দেখে বড়বাবু বললেন― ও সব ধান্দা ছাড়তে হবে। নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে। তোমার ওই খয়ের এখানে হবে না। আমার রাগ হল। বললাম, কেন হবে না? নদীর চরে খয়ের গাছের জঙ্গল আমি নিজের চোখে দেখেছি উত্তর-বাংলায়। এখানেও নদী আছে, চর আছে, চরে বালু আছে। তবে এখানে খয়ের হবে না কেন? গেলাম শেষে সাহেবের ঘরে। বড়বাবু হাজির। সব শুনে সাহেব বলে দিলেন— তোমার হিসেবমতো সবই ঠিকঠাক আছে মেনে নিলাম। তবুও খয়ের এখানে হবে না। বড়বাবুর নোটশিট বলেছে খয়ের প্ল্যানটেশন হিয়ার অ্যাট ডুলুং ডিহা রেড সয়েল ইজ ইমপসিবল ডিউ টু ক্ল্যাইমেটিক ফ্যাক্টর। নেচার সব কিছুকে সব স্থানে সফল হতে দেয় না। এই যেমন তোমাদের বড়বাবু সব কাজে কখনওই ‘হ্যাঁ’ বলবেন না।

কিন্তু স্যার এখানে খয়ের গাছ আছে। আমি দেখেছি। সাহেব বলেন― নিশ্চয়ই দেখেছ। আমিও বিশ্বাস করছি। কিন্তু সে গাছ আছে বিহারে। আমরা প্ল্যানটেশন করছি পশ্চিমবঙ্গে। তাই আমি বলছি না, তোমার বড়বাবু বলছেন যে পশ্চিমবঙ্গে খয়ের গাছ হওয়ার নয়।

তো আমারও জেদ চাপল। দশ দিন ছুটি চাইলাম। সেই দরখাস্ত দেখে খুব ভোরে আমার কোয়ার্টারে হাজির ডিএফও সাহেব। বললেন— ছুটি নিয়ে উত্তরবঙ্গে খয়ের বীজ আনতে যাবে তো। এই টাকাটা নিয়ে যাও। খরচ তো আছে। ‘না’ কোরো না― করে দেখিয়ে দাও যে ফাইলে যা-ই লেখা থাকুক, খয়ের গাছ এখানেও হতে পারে। চেষ্টা করতে দোষ কী? বড়বাবুকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। যা করার নিজেই করবে।

এ-ই হল আমাদের ডিএফও সাহেব। আর আমি তাই এখানে খয়ের বীজ পুঁতছি। সত্যি-মিথ্যে বলবে ভবিষ্যৎ। এই যে তোমাদের কাঁকরঝোরার জঙ্গল, এখানে প্রচুর হরতুকি গাছ আছে। গাঁয়ের মানুষ সেই বীজ কুড়িয়ে তিরিশ মাইল হেঁটে বিকোতে যায় ঘাটশিলা, বুরুডির হাটে। ওসব কথা আমার আপিসের রেকর্ডে লেখা হয় না। আমি এখন চলেছি হরতুকির চারা খুঁজতে। ময়ূরঝোরা, ঝাঁটিঝোরার জঙ্গলে সে চারা পেয়ে যাব। নিয়ে গিয়ে লাগাব ঝাড়গাঁয়ের জঙ্গলে।”

ক্রমশ প্রকাশ্য...
অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ১
অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ৩
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India