প্রতিটি পাপকর্ম করার আগে হিথক্লিফ সগর্বে ঘোষণা করে। আপাত-অসম্ভব সেই ঘোষণাকে সে কার্যকর করে কখনও বা ভয় দেখিয়ে বা গায়ের জোরে, কখনও বা প্রেমিক বা শুভাকাঙ্ক্ষীর অভিনয় করে। নায়ক এবং প্রতি-নায়ক, দুটি চরিত্রেই হিথক্লিফ অনবদ্য। হিথক্লিফকে বাধা দেয় এলেন ডিন। আর্নশ পরিবারের সে পরিচারিকা, এই গল্পের কথক। দুই পরিবারের প্রত্যেককেই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সে দেখেছে। এই গল্পে এলেন ডিনই সেই চরিত্র যে সর্বদাই পাঠককে কোনটা সঠিক হতো তা বাতলে দেয়। সে শুভ বুদ্ধি ও চেতনার প্রতীক। কেবল হিথক্লিফ নয়, হিন্ডলে বা এডগার, দুই ক্যাথারিন-সবাই তার কাছে মন খুলে স্বীকারোক্তি করে, ‘হায়! হিথক্লিফ যা বলেছে তার প্রভাব ব্যর্থ করার মতো কুশলতা আমার নেই।’
হিথক্লিফের প্রভাব শেষপর্যন্ত প্রতিহত হয় হেয়ারটন আর্নশ ও ক্যাথারিন লিনটনের প্রেমের কাছে। সাধারণত নিজেকে ঘৃণিত করে তুলতে হিথক্লিফ পছন্দই করে। নিজের প্রতি এডগার ও ইসাবেলার মনে ঘৃণা এবং ছোট লিনটনের মনে ভয় জাগাতে পেরে সে খুশিই হয়। নিজেকে সবল মনে করে। কিন্তু মৃত্যুর আগে সেই হিথক্লিফ নিজেই পরিচয় নিয়ে বিব্রত বোধ করে। সে বোঝে, সবাই তাকে একটিই চোখে দেখে। সে শয়তান। তার গতি হবে নরকে। নিজের পরিচয় যতো স্পষ্ট হয় তার কাছে ততো সে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। হেয়ারটন ও ক্যাথারিনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা দেখেও সে বাধা দিতে পারে না।
হিথক্লিফ শেষপর্যন্ত মারা যায়। মৃত্যুর আগেও তার মধ্যে কোনও অনুতাপ দেখা যায় না। বরং সে সগর্বে ঘোষণা করে, ‘অন্যায়ের জন্য অনুতাপের কথা বলছ… ধর্মের বাণীও শোনাতে হবে না।’ মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে তার শয়তানি। কবরখোঁড়ার লোকটিকে ঘুষ খাইয়ে রাখে। ক্যাথারিনের কবরের পাশেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর আগেই সে বলেছিল, ‘আমি খুবই সুখী… আবার যথেষ্ট সুখীও নই।’ সে যে যথেষ্ট সুখী নয়, সেটা বোঝা যায়, যখন মৃত্যুর পরও গাঁয়ের লোকেরা গির্জার কাছে, জলায়, ন্যাবের কাছে ওদের দু’জনকে ঘুরে বেড়াতে দেখে। এই দুই প্রেতাত্মাকে ভয় পায় না কেবল হেয়ারটন আর ক্যাথারিন। এলেন ডিন বলে, একসঙ্গে থাকলে দুটিতে শয়তান আর তার দলবলের মুখোমুখি হতে পারবে।
হিথক্লিফের মৃত্যুর আগে ও পরে করা দুটি মন্তব্য থেকে তার চরিত্রটিকে আরও ভালো ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁর মৃত্যুর আগে এলেন ডিন বলেছিল, ‘বিবেকের দংশনই হিথক্লিফের জীবনটা নরক করে তুলেছে। কীভাবে এর শেষ হবে, ভেবে পেলাম না আমি।’ আর মৃত্যুর পর জোসেফ মন্তব্য করে, ‘দেহ থেকে শয়তান মুক্তি পেয়েছে। মরা শরীরটা নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। কি শয়তানকে বাবা…মরেও দাঁত খিচোচ্ছে।’ হিথক্লিফের শরীর নিয়ে এই দর-কষাকষি যেন ‘ফাউস্ট’-কেই মনে করিয়ে দেয়। হিথক্লিফ শয়তানের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছিল। শয়তান তার সর্বশক্তি দিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে চূড়ান্ত সংঘর্ষের দিকে।
এই সংঘর্ষ চলে গোটা উপন্যাস জুড়ে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হিথক্লিফ সম্পর্কে করা বিভিন্ন মন্তব্য থেকেও এই সংঘর্ষের আঁচ পাওয়া যায়। ইসাবেলা প্রশ্ন করে, ‘হিথক্লিফ কি মানুষ? মানুষ হলে সে কি উন্মাদ? তা না হলে, সে কি শয়তান?’ এলেন ডিনের মনেও প্রশ্ন, ‘এ কেমন অপরাধ যা নিয়ে মানুষ বছরের পর বছর গুমরে মরে, প্রতিশোধের আকাঙ্খায় জ্বলতে থাকে আর এই আকাঙ্খা চরিতার্থতা করার জন্য নানা পরিকল্পনা করে, মনে একটুও অনুতাপ জাগে না?’ ক্যাথারিন লিনটনের সিদ্ধান্ত, ‘আমরা এই ভেবে প্রতিশোধের আকাঙ্খা মেটাব-আপনার এই নিষ্ঠুরতা আরও গভীর কোনও দুঃখ থেকে এসেছে। আপনি খুবই দুঃখী? তাই না? শয়তানের মতো নিঃসঙ্গ, শয়তানের মতোই ঈর্ষায় কাতর-তাই তো? আমি আপনার মতো হতে চাই না।’
গভীর দুঃখেই হিথক্লিফ তার আত্মাকে নরকে পাঠাতে চেয়েছে। তার নিঃসঙ্গতা ও ঈর্ষা-তাকে ঠেলে দিয়েছে নরকের দিকে। সে ভেবেছে, এইভাবে সে বেশ একটা শোধ তুলেছে আত্মার স্রষ্টার ওপর। কিন্তু স্রষ্টার মুখোমুখি হওয়ার এই প্রচণ্ড শক্তি ও আত্মবিশ্বাস সে কোত্থেকে পেলো? কোত্থেকে সে পেল বিরূপ ভাগ্যকে শাসন করার এই বিরাট স্পর্ধা? কোন বিরল সাহসে সে প্রতিটি পাপকর্মকে আগে নিজের সিদ্ধান্তকে ঘোষণা করতো, তারপর ঈশ্বরের মতোই প্রচণ্ড কুশলতা ও নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে প্রতিটি মানুষ ও পরিস্থিতিকে বাধ্য করতো সেই সিদ্ধান্তের অভিমুখে চালিত হতে?
আমাদের মনে পড়ে সফোক্লেসের বিখ্যাত নাটক ‘রাজা ইদিপাসে’র কথা। জন্মাবধি ইদিপাস ভাগ্যবিড়ম্বিত, আত্মপরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। আপোল্লোর অভিশাপের সে অসহায় শিকার। ইদিপিস নিজের ভাগ্যকেই চ্যালেঞ্জ করে। তারপর প্রচণ্ড শক্তিতে একের পর এক সুতো ছিঁড়ে উদঘাটিত করে আত্মপরিচয়ের রহস্য। উন্মোচিত হয়, তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি। মানবতার জন্য বলিপ্রদত্ত। তাই থিবস নগরীর সমস্ত পাপের ভার একা তাকেই বহন করতে হবে। হিথক্লিফও নিজের পরিচয় উন্মোচিত করতে ভয় পায় না। সে জানে, সে শয়তানের প্রতিনিধি। এটাই তার আত্মপরিচয়। আখ্যানের পরত খুলে খুলে তার পরিচয়ের প্রতিটি অংশ একটু একটু করে প্রকাশ হয়ে পড়ে। প্রতিটি পরত খোলার আগে সাহসের সঙ্গেই হিথক্লিফ সেই উন্মোচনের মুহূর্তটি ঘোষণা করে।
হিথক্লিফ হেরে যায়। জিতে যায় হেয়ারটন ও ক্যাথারিন। হেয়ারটন আর্নশ ফিরে পার উদারিং হাইটস। ক্যাথারিন লিনটনও ফিরে পায় থ্রাসক্রস গ্র্যাঞ্জ। হিথক্লিফের ভালোবাসা তাকে টেনে নিয়ে গেছিল শয়তানের দিকে। হিথক্লিফের ঘৃণা ফিরিয়ে দিল প্রেম, ভারনাম্য ও শান্তি। হেয়ারটন ও ক্যাথারিন সেই শুভবোধ ও স্বর্গের প্রতিনিধি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিথক্লিফ তাই বলে ওঠে, ‘কাল রাতে আমি নরকের দরজায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। আজ আমার স্বর্গের দেখা পেয়েছি। স্বর্গের দিকেই আমার দৃষ্টি এখন-মাত্র তিন ফুটের ব্যবধান।’ হিথক্লিফের মৃত্যু এবং হেয়ারটন ও ক্যাথারিনের ভালোবাসা সে ব্যবধানকেই মুছে দিল।
আসলে এমিলি ব্রণ্টি এই স্বর্গকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। শয়তানের জন্য তাই তিনি এত দীর্ঘ অথচ অনিবার্য শাস্তি নির্দিষ্ট করেছেন। দস্তয়েভেস্কি ‘মিশকিন’ চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে চরিত্রায়িত করতে চেয়েছিলেন। দেখাতে চেয়েছিলেন মানবতার জন্য তার আত্মবলিদান। উপন্যাসের শেষে মিশকিনের নিঃস্বতা ও নির্বাসন সেই বলিদানেরই অংশ। এমিলি ব্রণ্টি দেখিয়েছেন শয়তানের সীমাবদ্ধতা ও তার পরাজয়। দেখিয়েছেন তার মৃত্যু ও নিঃস্বতা। শয়তানকে বলি দিয়ে। তার আত্মদ্রোহের মধ্য দিয়ে এবং তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে তিনি শুদ্ধ বসবাসযোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন মানুষের দুনিয়াকে। শয়তানকে চরিত্রায়িত করলেও ব্রণ্টি তাই দস্তয়েভস্কির মতোই, ‘উওম্যান অব গড।’
সমাপ্ত