অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ৪

ঘুম আসেনি। তাই বসে আছি বনবাংলোর বারান্দায়। মাঝরাতেও আমি একা নয়। ঝিরঝিরে হিমেল বাতাস ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙছে মরসুমি ফুলের ঝোপ। বুনো গোলাপের সুবাস বাতাসে ভেসে শিশিরবিন্দুর মাথায় তরঙ্গ জাগিয়ে অদৃশ্য আলপনা এঁকে মিশে যাচ্ছে সীতাহার ফুলের মিঠেকড়া সুবাসের সঙ্গে। তারপর ওরা হাতে হাত ধরে পাশাপাশি ভেসে বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরের বন-পাহাড়-মাঠ পার হয়ে সমতলের কোথাও, কোনো অরণ্যবালার আঙিনায়। সামনে মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে চাঁদবুড়ি। শিশিরে ভেজা বুড়ি চাঁদ যেন মেঘের ভেলায় চেপে শূন্য সাগরে সাঁতার কেটে উজানস্রোতের রেখা বরাবর তীব্র বেগে চলেছে অসীমের পানে। মনে হয় এই বুঝি সে আছড়ে পড়ে খানখান হয়ে যাবে কঙ্করঝোরার রুপোলী জালে। পৌষশেষের ধান কাটার ঋতু প্রায় শেষ হয়ে এল। সামনে পরব। মকর আর আখান পরবের প্রস্তুতি গ্রামে গ্রামে। নতুন ধান কোটার গন্ধও ভাসছে নীচের উপত্যকায়। শাল বনে সুর উঠেছে টুসু গানের। মাঝিগাঁয়ে রাতভর ডানঠা নাচ, আর মাদলের বোল। পরব আসছে।

rangamati_05

শিল্পীঃ সুদীপ চক্রবর্তী

ললিতদা অরণ্য দেখে আনমনে। অরণ্য ওর রক্তে নেশা ধরায়। যুগলপ্রসাদ আর ললিত বেরা; সময়ের ব্যবধান দু-যুগেরও বেশি। নাঢ়া বইহার, সরস্বতীকুন্ডি, কঙ্করঝোরা, লালজলা, বুরুডি, সিংবুরু, পাবরা পাহাড়, ঝালিয়ার বন-পাহাড়ে এ রকম কতই না অরণ্যপাগল মানুষ আছে কে তাদের খবর রাখে। বহু দূরে দোলন দিয়ার বনেও বয়ে যায় সরস্বতীকুন্ডির বুনো বাতাস। সেই বাতাস হয়তো আজও বয়ে আনে হংসলতা, হোয়াইট বিম, রেড ক্যামব্রিয়াম, নাগকেশর, পারুইচাঁপার মতো আরও কত নাম না-জানা ফুলের গন্ধ। মেঘ, সমুদ্র, মৌসুমি বাতাসের মতোই ‘আরণ্যক’ প্রবীণ হয় না কখনও। যুগলপ্রসাদ, ললিত বেরার মত খেয়ালি মানুষেরাও যুগের পর যুগ ধরে বেঁচে থাকবে সময়ের চতুর্থ মাত্রা বরাবর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেই। সবার অলক্ষ্যে। আনমনে। ওদের নিজেদের অরণ্যজগতে। একান্তে। সভ্য জগতের দৃষ্টির আড়ালে।

ভোর হয়ে আসছিল। অন্ধকার পাতলা হতে হতে কখন যে সুদূর দিকচক্রবালে রামধনু-রঙ ধরেছে খেয়াল করিনি। সাত রঙের সমান্তরাল তরঙ্গমালা মিলেমিশে কমলা রঙের আবির ছড়াচ্ছে পাহাড়চূড়ায়। এগিয়ে এসে সে মুঠো মুঠো গেরুয়া আবির দোল খাচ্ছে কেঁদ-বহেড়ার ডগার কুশিতে। হাঁটছে ললিতদা, হারিয়ে যাচ্ছে শাল বনের ছায়ায় ছায়ায়। অবিরাম ওর পথচলা। পাহাড় থেকে পাহাড়তলির অরণ্যবলয়ের গভীরে। বনের পাকদণ্ডী বেয়ে সে নেমে যাচ্ছে নিভৃতে গিরিকন্দের নিভৃত নির্জনে। অনেক দূরে লাটা ঝোপের আবডালে নবজাতক দলমার দামাল শিশুর ঘুম ভাঙল এ বার। তীব্র শাঁখের শব্দে বৃংহণ … স্বাগত জানাচ্ছে ভোরের আলোর আলপনাকে। নির্জনে ভোমরা উড়ল কাজলকালো ডানা মেলে, বুনো ফুলের মধু-র খোঁজে। হিমেল হাওয়া হিমকুঁড়ি দুলিয়ে দূরে চলে গেল গাছের আগায় কাঁপন জাগিয়ে। টুপটাপ শিশির ঝরছে মাটিতে।…

দু-বছর বাদে আবার এলাম ঝাড়গ্রামের সবুজ-ঘেরা লালমাটির আলুথালু শাল বনে, বেড়াতে নয়, ঠিকে বসত গড়তে পেশার টানে। ছোট্ট শহর। শান্ত শাল বীথির ছায়ায় মোড়া জনপদ। রেল ষ্টেশনের অদূরে বাসস্ট্যান্ডেও বিশেষ কোলাহল নেই। পথপাশে ‘পান্থসখা’। কবি অশোক মহান্তির আশ্রমবিশেষ। কে যেন দেওয়ালে পোস্টার মেরে গেছে— ‘ভয় পেয়ো না, কবিদের ঝগড়া করিবার স্থান।’ এই শান্ত জনপদে লেখকদের জন্য অবারিতদ্বার পান্থসখা।

মধুবন পার হয়ে হাঁটছিলাম চায়ের খোঁজে। হঠাৎই শুরু হল পথিপার্শ্বে মরসুমি ফুলের মেলা। রাঙামাটির চাদরের ওপর ছড়ানো ফুলের বাগান। রঙের মেলার রামধনুজালিকা। হাঁটতে গেলে আজও এখানে এসে থমকে দাঁড়াতে হবেই। এ বারও সেই পৌষালি সকাল। গাছের পাতায় কুয়াশাবিন্দুর মালা। সদ্য-কিশোরী দুই কলেজবালাও থমকে দাঁড়িয়ে আছে বেড়ার পাশে। লুব্ধ চোখে ওদের চোরা চাহনি আধফোটা বসরাই গোলাপকুঁড়ির দিকে। বাঁ দিকে হাসি ছড়াচ্ছে ফ্লকস, পিটুনিয়া, ডায়ান্থাস, ন্যাসটারসিয়াম। সামনে ক্যালেনডুলা, সিলভিয়া, স্যুইট

 

-পি। তাদের আলুলায়িত দলমণ্ডলে ভাসছে শত শত রঙিন ফড়িং। জোড়ায় জোড়ায় উড়ছে হরেক রঙের প্রজাপতি। মোরাম-ঢালা প্রশস্ত পথের দু-পাশে জোড়া শ্বেত চন্দনের ডালে বসে একজোড়া ঘুঘু একে অপরের ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে। তেজপাতা গাছের ঘন ছায়ায় দু-জোড়া কাজলগৌরী। চোখ-জুড়ানো রঙের বাহার তাদের ডানায়।

হঠাৎই পিছন থেকে কে যেন এসে চোখ টিপে ধরে প্রশ্ন করে― “বলো তো লেখক, কে বঠি আমি?” সেই পুরনো কণ্ঠস্বর। আমি বলি “ললিত বেরা … তামাম জঙ্গলের মালিক বঠে।”

“ঠিকেই বলিছ হে লেখক, টুকু ভুল হল তবু, মালিক না—মজুর।”

“এ বার বেড়াতে নয়। এ বার এসেছি থাকব বলে।”

“এই তো মরদের মতো কথা হে। দারুণ সব লেখার বিষয়বস্তু আছে হেথা।”rangamati_02

“ঘাটশিলার রাস্তায় কাঁকরঝোরা গিয়েছিলাম। তামাজুড়ি হয়ে পরশু ফিরেছি। তোমার খয়ের গাছগুলো বেশ বড় হয়েছে। আরও কত গাছ দেখলাম নতুন নতুন। ফুল ফুটেছে রকমারি। শিয়ারবিঁধায় তোমার খোঁজ করতে বলল, তুমি বদলি হয়ে গেছ। আজ এখানে তোমাকে পেয়ে যাব ভাবিনি। আছ কেমন?”

“খুব ভাল আছি। আরে বাপু, আমি কোথাও খারাপ থাকি না হে। চলো খয়ের গাছ দেখাই।” বলেই টেনে নিয়ে গেল পশ্চিম কোণে। বলে― “কী দেখছ বলো তো হে, কী গাছ এই দু-জোড়া?”

আমি বলি— “আরে! খয়ের গাছ এখানেও লাগিয়েছ। আরে! এ দু-জোড়া চিকরাশি। দার্জিলিঙে পাহাড়ে দেখেছি।”

“এখানেও হয় হে। মাটি কখনও বন্ধ্যা হয় না। বিশ্বাস হল তো। এ বছর থেকে রাজ্য সড়কের দু-পাশে বনদপ্তর প্রচুর চিকরাশি পোঁতা শুরু করতে চলেছে।”

“কিন্তু তোমার বড়বাবু, সাহেবরা দেখেছেন এ সব?”

“ওইখানেই তো মজা রে দাদা। পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে আমাদের ডিএফও সুলতান সাহেবকে  খয়ের গাছ দেখিয়ে এনেছি।”

“মির্জা আসগর সুলতানের কথা বলছ কি? উত্তরবঙ্গে ছিলেন খুবই জেদি মানুষ। জাঁদরেল অফিসার। বিলক্ষণ চিনি ওঁকে। এ সব খয়ের, চিকরাশি দেখে কী বললেন তিনি?”

“আরে বাপু, শিক্ষিত মানুষ। জঙ্গলবিশেষজ্ঞ। বললেন― মি. ললিতবাবু, এখন তো আর তোমার খয়ের চারা বিহার সীমান্তের ও-পারে নেই। এ রাজ্যেও চলে এসেছে। এবার তুমি সর্বত্র খয়ের প্ল্যানটেশনের সরকারি নির্দেশ অবশ্যই পাবে। কিন্তু স্যার, বড়বাবু নোটশিটের কী হবে? শুনে সাহেব বলেন— ডোন্ট বিহেব লাইক আ পেপার টাইগার। গেট রেডি অ্যান্ড প্রিপেয়ার ইওরসেলফ। বিকজ ইওর জব উইল মেক ইউ অ্যালাইভ ইন ফিউচার। চারা তৈরি করতে শুরু করো। অফিস আমি সামলাচ্ছি।”

“কিন্তু তোমার সেই বড়বাবু তো আর ছেড়ে কথা বলার মানুষ নয়। বিশেষ করে লিডার যখন”, আমি বলি। জবাবে ললিত বলে— “সাহেবের মুখে সব শুনে তো বড়বাবু আমার ওপর রেগে আগুন তেলে বেগুন। সাহেব ওঁকে বললেন দেখে আসতে। তা ওঁর সময় কোথায়? সম্মেলন, মিটিং, মিছিল, তহবিল-সংগ্রহ … ৩৬৫ দিনে হাজার-তিরিশটিরও বেশি কাজ। আমাকে প্রকাশ্যেই ধমকে বললেন― ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়েছ, দ্যাখো কী হয়? তা দু-মাসের মাথায় আবার বদলির নোটশিট ঝাড়লেন উনি। সাহেব শেষ পর্যন্ত মাঝামাঝি রফা করে আমাকে এখানে বদলি করে আনলেন। আর আমি এখানে এসেই চার জোড়া খয়ের গাছ লাগিয়েছি।”

এখন মরসুমি ফুলের পাপড়ির আগায় চুমকি রঙের শিশিরবিন্দু সোনালি ঝিলিক। ললিতদার বাগানে সাতাশ রকমের গোলাপ। এই রাস্তায় স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদের আবিরাম যাতায়াত। ফুলের টানে ওরাও ঢোকে বাগানে। ললিতের ঠোঁটের ভুবন-ভোলানো হাসির তুফান ছড়িয়ে যায় তাদেরও ঠোঁটের ডগায়। গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকারাও হাসে।

প্রায় তিরিশ বিঘার রঙিন ফুলের বন। ললিতদা এখানে আরণ্যক মায়ের স্নেহ-মমতা ঝরিয়ে লালন করে চলেছে রঙের অরণ্য। জবা আর টগরের টানা বেড়া। আর তারই সমান্তরাল বিশল্যকরণী বৃত্তাকারে গিয়ে মিলেছে শ্বেত চন্দনের দুয়ারে। বোতলব্রাশ ফুল নুয়ে পড়ে মাটি ছুঁয়েছে। উত্তর-পুবের কোণ বরাবর বাঁক নিলে চোখে পড়বে সুন্দরী আর রুদ্রাক্ষ গাছ। সুন্দরবনের নোনা মাটির সুন্দরী লাল মাটির গভীরে শেকড় ছড়িয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে আকাশে শাখা মেলেছে। ললিতদা দিন গুনছে কবে ওর শ্বাসমূল মাটিতে ডানা মেলবে, তা দেখার। টবে সারি সারি পাম। দূরে পাইন আর ধুপির সারি। পাশাপাশি আরকেরিয়ার মেলা। টবেতেই ফলছে আখরোট। সুদূর হিমালয়ের গাছ যে এই উষ্ণ বলয়ের ভয়ানক গরমের মাটিতেও ডানা মেলতে পারে ললিতদা তা প্রমাণ করেছে।

কিছু দূরে বত্রিশ রকমের ক্যাকটাস, কাঁটা-জড়ানো সবুজের বলয়গ্রাস। বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, কেঁদ, আমলকী এমনকী বকুলেরও বনসাই। থিরথিরে বাতাসে দুলছে ‘হাইনেক থুজা’। পাশাপাশি কাঁটাঝাউ-তে বুলবুলির বাসা। ক্যাসুরিনা আকাশ ছুঁতে চলেছে। ফি বছর বর্ষায় এখান থেকেই সরবরাহ হয় এক লক্ষ চারাগাছ। কাজু, সেগুন, মেহগিনি, দেওদার, জ্যাকারান্ডা, শাল, পিয়াল, মহুল, মহানিমের চারা কিনতে দূর-দূরান্তের মানুষ আসে এখানে। আসে গাছের টানে, আসে বনপাগলা ললিতের টানেও।

ভিতরেই বন-আবাসনের সামনে শালগম, গাজর, মুলো, নানা রকমের শাক, পালং, বেগুন আর টোম্যাটোর মেলা। হাসছে ফুলকপির কলি। বেনেবউ-জোড়া ঊড়ে যেতেই সেই ডালে এসে বসে একাজোড়া নীলকণ্ঠ বসন্ত। ওই তেজপাতা গাছেই বাসা বেঁধে নিশ্চিন্তে সংসার করছে কয়েক জোড়া টুনটুনি। বকুল গাছের তলায় বাঁধানো চত্বরে বসে ইতিমধ্যেই তিন রাঊন্ড চা সাবাড় করেছি। বউদি হুকুম জারি করেছেন লুচি হচ্ছে। না খেয়ে ওঠা যাবে না। কিছু দূরে মাচার ওপর বিশাল সবুজ লাঊ, কুমড়ো, শশার প্রদর্শনী। কয়েক জন স্কুলের বাচ্চা সেগুলোকে নজর করছিল বহুক্ষণ ধরেই। ললিতদা ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে— “কী হে ছানাসকল, শশা দেখচু, লিবার মরদ নাই। যা, ছেঁড় গাছ থেকে। খা কেনে পেট ভরে। গাছ নষ্ট করবিস নাই।” বাচ্চাগুলো শশা ছিঁড়ে নিয়ে ছুট লাগায়।

ঘরে ফেরার পালা। গেট পার হয়ে রাঙামাটির রাস্তায় উঠে আসি। হাঁটছি উত্তরের শাল বনের দিকে। ললিতদা মিলিয়ে যাচ্ছে বনের সবুজে। অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রামের আরণ্যক মানুষটি দু-হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রভাতী অতিথিকে। ওর দু-হাত নড়ছে বনশিউলির ঝোপের মাথায়। আমার চশমার কাচে জমাট কুয়াশার আস্তরণ। সামনেও বই-খাতা কাঁধে কচিকাঁচাদের সবুজ মিছিল। দূরের স্কুলে বাজছে সকালের ছুটির ঘণ্টা।

অরণ্য আছে, থাকবেও। শাশ্বত সবুজের বাণী। এদেরই কেউ হয়তো আরও তিরিশ বছর পরে কলম হাতে খুঁজে পাবে এরকমই কোনো যুগলপ্রসাদকে। ললিতরা হারায় না। নিঃশেষ হয়েও যায় না। যতই ভোগবাদের ধোঁয়াশা জমুক চারাধারে। ওরা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবেও।

সমাপ্ত
অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ৩
বাসব দাশগুপ্ত – “ পৌষের কবিতা ”
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India