বিপ্লব মাজী – “ ডাস্টবিন ” ১

illustration_01কোন আবর্জনা ফেলার জায়গাকে ডাস্টবিন বলে। এই ইংরেজি শব্দটি বাংলা ভাষায় ডাস্টবিন নামেই পরিচিতি পেয়েছে। যখন আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রযুক্তি ও অর্থনীতির উন্নতি গ্রাম ও শহরের তফাৎটা ক্রমাগত স্পষ্ট করতে থাকে, বিভিন্ন শহরকে কেন্দ্র করে দেখা দিতে থাকে সভ্য নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি। শহর তো গ্রাম না, যে যেখানে সেখানে মলমূত্র ফেলা যাবে, আবর্জনা ফেলা যাবে। অতএব শহরকে কেন্দ্র করে, নাগরিকদের সুযোগ সুবিধে দেওয়ার জন্য তৈরি হল এক একটি মিউনিসিপ্যালিটি, আর যেখানে যেখানে একটা বড় শহরের পেটের ভেতরে দশ-বিশটা ছোট শহর ঢুকে গেল, তৈরি হল কর্পোরেশন। এইসব মিউনিসিপ্যালিটি বা কর্পোরেশনকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য শহরে জল সরবরাহ ব্যবস্থা, নালা-নর্দমা-পায়খানা (যার বর্তমান গালভরা নাম টয়লেট বা ওয়াশ-রুম) ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা জোরদার করতে হল, তা না হলে শহরে জমা আবর্জনার দুর্গন্ধে শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে পালাত। স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকলে, শহরের আবর্জনার স্তূপ থেকে নানা রোগ মহামারি ছড়াত। শিল্প বিপ্লবের আগে ও পরে, ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে আমরা পাই, বেশ কিছু নগর ও শহর প্লেগ মহামারিতে ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ থেকে (২০১৭) একশ বছর আগেও, পৃথিবীর নগর জীবন প্লেগ মহামারিকে ভীষণ ভয় পেত। যার একটি দৃষ্টান্তমূলক বিবরণ আলবার্ট কামুসের ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে আছে। সে যাই হোক, যে কোন শহর জীবনে প্রতিদিন প্রতিটি গৃহস্থে যে আবর্জনা জমে, তা ফেলার জায়গা হল পথের ধারের ডাস্টবিন। মিউনিসিপ্যালিটি বা কর্পোরেশন শহরের মোড়ে মোড়ে বা বিশেষ বিশেষ স্থানে ডাস্টবিন-এর ব্যবস্থা করেন। সেই ডাস্টবিনে নাগরিকরা যে আবর্জনা ফেলেন, তা মিউনিসিপ্যালিটি বা কর্পোরেশনের গাড়ি এসে পরিষ্কার করে তুলে নেয়। তারপর শহরের বাইরে কোন স্থানে ফেলে আসেন। সাধারণত শহরের সমস্ত ময়লা এক জায়গায় ফেলে আসার স্থানটিকে বলা হয় ধাবা।

শৈশবে (১৯৫৩-৫৪) গ্রাম থেকে যখন মেদিনীপুর শহরে এলাম শহরটি তখন ৪ × ৪ বর্গমাইল মাত্র। ছোট শহর। শহরের সব রাস্তাই মোরামের। পথে পথে তেকোনা কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলে। কাঁধে সিঁড়ি, মাথায় বা ঘাড়ে কেরোসিনের টিন একটা লোক পথে পথে বাতি জ্বেলে যায়। সে বাতির নিষ্প্রভ আলো যতক্ষণ বাতিটিতে কেরোসিন থাকে জ্বলে। তখন দেখতাম শহরের পাড়ার মোড়ে মোড়ে এক একটা গোলাকৃতি টিনে ঘেরা পরিসর ডাস্টবিন। পাড়ার সবাই সে ডাস্টবিনে আবর্জনা ফেলে। হপ্তায় একদিন মিউনিসিপ্যালিটির লরি এসে ডাস্টবিন থেকে আবর্জনা তুলে নিয়ে, শহরের বাইরে ধাবায় ফেলে আসে। দেখতে দেখতে ধাবা হয়ে ওঠে আবর্জনার পাহাড়। মেদিনীপুর শহরের প্রান্তিকে ধর্মার ওধারে যে কলকাতা-মুম্বাই হাইওয়ে ছেদ করে রানিগঞ্জ সড়ক চলে গেছে, তার পাশে ধাবা। একসময় কংসাবতীর ব্রিজ হয়ে যাত্রী গাড়ি শহরে সরাসরি না ঢুকে, যখন রানিগঞ্জ সড়ক ধরে ধর্মা হয়ে শহরে প্রবেশ করত। ধাবার দুর্গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসত। বর্তমানে নানা রাসায়নিক ব্যবহার করে, ধাবার দুর্গন্ধ দূর করা হয়, যার ফলে ধাবার কাছেই ইতিমধ্যে আবাসন ও হোটেল-লজ তৈরি হয়ে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে ধাবাও হয়ত শহরে ঢুকে যাবে। আমরা বলি ধাবা, আসলে ওটাও তো একটা বেশ বড় আকারের ডাস্টবিন। কলকাতার মতো বড় শহর বা কর্পোরেশনের সমস্ত ময়লা যেখানে শত শত গাড়িতে নিয়ে গিয়ে উগরে ফেলা হয়, সেই ধাবার পাশেই তো সায়েন্স-সিটি, রুবি হাসপাতাল, দিশান, রিয়েল এস্টেটের ছড়াছড়ি, মিলন মেলা, আরো কত কি! বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ কলকাতা কর্পোরেশনের ধাবা বা ময়লা ফেলার বড় ডাস্টবিনকে দুর্গন্ধ ও দূষণ মুক্ত করে ফেলেছে। নগর সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে ডাস্টবিনের চেহারা বদলে যাচ্ছে। গোলাকৃতি টিনের ঘেরা পরিসর থেকে চারপাশে সিমেন্টের দেয়াল ঘেরা ডাস্টবিন চালু হল। ডাস্টবিন থেকে আবর্জনা তোলার যন্ত্রপাতি, কৃৎকৌশলও দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে। মানুষকে আগে যেভাবে ডাস্টবিনের আবর্জনার ময়লা ঘেঁটে গাড়িতে তুলতে হত। এখন সে কাজ অনেকটাই যন্ত্র করে দেয়। ভবিষ্যতে হয়ত রোবটরা ময়লা তুলবে।21766464_1707896005910688_6351780128347176346_n

বিগত শতকের নয়ের দশকে বিশ্বায়নের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত। ডাস্টবিন প্রধানত আমাদের নগর জীবনের পাবলিক স্ফিয়ারে ছিল। শিল্পবিপ্লব শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটায়নি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পশ্চিম ইউরোপ থেকে জাহাজ ভাসিয়ে দেশে দেশে উপনিবেশ তৈরি করেছিল, আর সেইসব উপনিবেশে ঔপনিবেশিক প্রভুরা বাজার তৈরি করেছিল, যাতে যন্ত্রে তৈরি প্রভূত মাল পণ্য হিসেবে দেশে বিক্রি হয়। সে ছিল উপনিবেশ তৈরির যুগ। আর এই বিশ্বায়নের দ্বিতীয় পর্বও এক নতুন ধরনের উপনিবেশ তৈরির যুগ। যারা তা তৈরি করছে দৃশ্যতই অদৃশ্য। পৃথিবীর মুক্ত বাজারে পণ্যসম্ভার বিক্রি করে দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য তারা মুক্তবাজারে বা ওপেন-মার্কেটে নিত্য নতুন মডেল ও পণ্য সরবরাহ করছে। আগে যেমন একটা সাইকেল তিন প্রজন্মের মানুষ ব্যবহার করত, বর্তমানে একজন মানুষ পাঁচ বছরে পাঁচটা নতুন নতুন মডেলের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ফলে প্রতি বছর কোটি কোটি কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন মার্কেটে যেমন আসছে, কোটি কোটি পণ্যসম্ভার ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে! ডাস্টবিনেরও মডেল বদলে যাচ্ছে। ডাস্টবিন এখন শুধু আর পাবলিক-স্ফিয়ারে ব্যবহার করা হয় না। প্রাইভেট-স্ফিয়ারেও ব্যবহার করা হয়। যেমন আমার স্টাডিতে ১২ ইঞ্চি উচ্চতা ও ৮ ইঞ্চি চওড়া ধূসর রঙের একটি ডাস্টবিন আছে। দৃশ্যতই সুন্দর মডেল। আমাদের দুটো বেড রুমে এবং হলঘরেও আছে। পলিমার ও অন্য ধাতুর মিশ্রণে তৈরি এইসব ডাস্টবিন বর্তমানে নাগরিক জীবনে অপরিহার্য। ডাস্টবিনকে পণ্য করেও যে বহুজাতিক ব্যবসা সারা পৃথিবী জুড়ে করা যায়, এ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। এইসব সুদৃশ্য ডাস্টবিন আজ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে, না করে উপায় নেই, এক ডাস্টবিন থেকে অন্য ডাস্টবিনে, সেখান থেকে অন্য ডাস্টবিনে স্থানান্তরিত হচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে যে ডাস্টবিন ছিল শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার স্থান বা পরিসর – সবার অলক্ষ্যে সেই ডাস্টবিন-প্রকল্প বা ধারনাটি বর্তমান মানব সভ্যতার বাঁচা-মরার ডিসকোর্স তৈরি করছে। ডাস্টবিন না হলে এই মানব সভ্যতা ভয়ঙ্কর এক ধ্বংসের মধ্যে প্রবেশ করবে। নিছক ৬ ফুট বাই ৫ ফুট ডাস্টবিনের বদলে আজ আমাদের চাই মহাজাগতিক ডাস্টবিন, না হলে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার দূষণের প্রভাবে যে বিশ্ব-উষ্ণায়ন ঘটবে, একদিন সমগ্র পৃথিবীতে স্প্রেংলার কথিত নীরব বসন্ত এসে যাবে, পৃথিবী একখণ্ড পাথর হিসেবে থাকবে, সেখানে কোন মানবসভ্যতা থাকবে না।

ক্রমশ প্রকাশ্য...
সুদীপ দাশ – “ নিশ্চিন্দিপুর ”
বিপ্লব মাজী – “ ডাস্টবিন ” ২
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India