ঝুমুর পাণ্ডে – “ ডাস্টবিন ” ২

পেঁচাটা আবার ডাকছে। ডাকুক। আবার পাশ ফিরল অমিতা রাণী। চালের ফোকর দিয়ে এখন চাঁদের আলো ঢুকছে ওর ছোট্ট ঘরে। চারদিকে জিনিসে ভরা। কি নেই, সমীর বাবুদের ফেলে দেওয়া সব জিনিসই এনে ঘরে ভরে অমিতা রানী। ভাঙা চেয়ার, ছেঁড়া পাপোষ, ভাঙা বালতি, জঙ লাগা ছুরি, ছেঁড়া বিছানার চাদর, তোষক, লেপ, কম্বল, শিশি বোতল, এমনকি ফেলে দেওয়া পুরোনো লিপস্টিক, শুকিয়ে যাওয়া নেল পালিশের শিশি, ক্লিনজার, বডিওয়েলের শিশি সব এনে জড়ো করে আমিতা রানী। সমীরবাবুর মেয়ে তাই ওকে নাম দিয়েছে ডাস্টবিন। এখন আর ওদের কষ্ট করে নিয়ে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলতে হয় না কিছু। জীবন্ত ডাস্টবিনই সব কিছু বহন করে, ধারণ করে, করে লালনও। এমনকি ফ্রিজে রাখা নষ্ট হয়ে যাওয়া তরিতরকারি, রান্না তরকারি খারাপ হয়ে যাওয়া সব কিছু। সমীরবাবুর কলেজে পড়া মেয়েটা যখন অল্প খেয়েই উঠে পড়ে। থালায় পড়ে থাকে যত সুস্বাদু খাবার মা বলে—  ফেললি কেন এত কষ্ট করে বানালাম—  মেয়েটা তখন হি হি করে হাসে। ডাস্টবিন আছে না! আর অমিতা রানীরও কোন ঘেন্না পিত্তি নেই। সব কিছু ধারণ করে। হ্যাঁ সব কিছু। …

আবার পাশ ফিরল অমিতা রানী। এখন একটা রাতজাগা পাখি ডাকছে ঝি উঠ। বউ উঠ। ঝি উঠ … মালিকনী সবিতা রাণীর ঘরেও অধিবাসের ধামাইল দিচ্ছে মেয়ে বউরা—

কুঞ্জ সাজাও গিয়া

সব সখি মিলিয়া

এগো মনো রঙে সাজাও কুঞ্জ

হরষিত হইয়া …

এখন কোন রাত জাগা পাখি যেন উলু দিচ্ছে। জেগে থাকলে কত রকম শব্দ যে কানে আসে। রাতটাকে কখনও বীভৎস আবার কখনও বড় মায়াময় মনে হয় অমিতা রাণীর। ছেড়ে যাওয়া স্বামীটা মাঝে মাঝে আসে। ওই ওর এখনকার বছর বিয়ানী বউটার যখন প্রসব হয়। শরীর খারাপ হয়। তখন বাঁজা অমিতা রাণীর শরীরটার দরকার পড়ে স্বামীটার। তখন এসে ভাল ভাল কথাও বলে। আর অমিতা রাণী কি করবে ওরও শরীর তো কোন শরীর চায়। তখন তাই আহ্লাদে গলে যায় অমিতা রাণী। আর শরীর ছেড়ে উঠে ওই স্বামীটা যখন অমিতা রাণীর কষ্ট করে জমানো পয়সাগুলো নিয়ে যায়। তখন কিছুই বলতে পারে না অমিতা রাণী। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। ঘুঘনিওয়ালা রতীশ এসে বোধহয় এখন হল্লা করছে। রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে হল্লা করে অথচ দিনে বেশ ভাল মানুষ। অমিতা রাণীকে যখন তখন অনেক কাজে কামে সাহায্যও করে। একটা রিক্সা গেল টুনটুন করে। নিশ্চয় এটা লক্ষণ, লক্ষণই এমন রাতে ফেরে। আবার পাশ ফিরল অমিতা রাণী। চারপাঁচটা ঘরে কাজ করে শরীরে ব্যাথা হয়ে যায়। আজ একজন নতুন ব্যাঙ্কের বাবুর ঘরে কাজ নিয়েছে। কিন্তু ওর নাম অমিতা রাণী শুনে ওর বউ হেসে কুটি কুটি হল। এতে হাসার কি আছে? সমীরবাবুর বোনের বোনের নামও তো অমিতা। শেষে হাসির কারণ বুঝতে পারল ওরা নাকি পেঁপেকে অমিতা বলে। যাকগে, একটা ট্রেনের শব্দ, বোধহয় স্টেশনে ঢুকছে। না, ঘুমটা কেন যে আসছে না। পেঁচাটা আবার ডাকছে। ওদিকে আবার কে কানছে। ডাক। ডাক। ডাকরে পেঁচা আমার আর কিতা কু হইব? হাই তুলল অমিতা রাণী। ওদিকে আবার হচ্ছে—

জাগো রে কৌশল্যা নন্দন

অধিবাসের সময় বহিয়া যায় …

অনেক পাখ-পাখালি ডাকছে। তার মানে কি ভোর হয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়েছিল কি! চারিদিকে তাকায় অমিতা রাণী। ভাঙা চোড়া ডাস্টবিনের ভেতর শুয়ে আছে আরেক ডাস্টবিন। সমীরবাবুর মেয়ে ঠিকই বলে ওকে ডাস্টবিন। টিনের দরজাটা এত ভোরে কে ধাক্কা মারছে। উঠে বসল অমিতা রাণী। টিনের ভাঙা দরজা এমনি খুলে গেল। এমা একি সমীরবাবুর বউ এত ভোরে? হাতে একটা ঘুমন্ত জ্যান্ত পুতুল ফ্লানেল দিয়ে মোড়া।

নে । ধর । ধর ।

আবার ট্রেনের শব্দ।

জানিস তো মেয়েটার সামনের মাসে বিয়ে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। এর মধ্যে মেয়েটা এক বন্ধুর সঙ্গে এনজয় করতে গিয়ে বাধিয়ে বসল, কি করি বল? এত পরে ব্যাপারটা জানতে পারলাম যে করার কিছু ছিল না।

আমিতা রাণী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়।

অনাথ আশ্রমে দিলেও নাম ধাম সে আরেক হ্যাপা।

illustration_091

শিল্পীঃ সুদীপ চক্রবর্তী

ডাস্টবিনে ফেললেও …

জ্যান্ত ডাস্টবিন অমিতা রাণী এখন কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল …

সবিতা রাণীর ঘরে এখনও গান হচ্ছে—

আর তো নিশি নাইগো সখি

আর তো নিশি নাই

এগো আইল না আইল না কুঞ্জে

রঙ্গিলা কানাই …

সমাপ্ত
ঝুমুর পাণ্ডে – “ ডাস্টবিন ” ১
প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়– “ আস্তাকুঁড় ”
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India