তৃপ্তি সান্ত্রা – “ ডাস্টবিনের জন্য ” ২

“ ডাস্টবিনের জন্য ” ১

এইভাবে কখন বাবু কলোনির বুকেও ধাক্কা দিচ্ছে অন্য স্রোত। অসম্ভব একটা বিরুদ্ধ মত তৈরি হচ্ছে। যে সিনেমা সাহিত্য সবার ভালো লাগত, ভালো লাগছে না। যে উপন্যাস, গল্পকে সবাই ছিঃ ছিঃ করছে—  তত খারাপ লাগছে না।

হাতে এসেছে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’, আশিসদা শোনাচ্ছেন ‘জনান্তিকে’—  আবৃত্তির হাততালি কবিতা, রাগী কবিতা, আবেগের থরো থরো কবিতার চেয়ে কত দূরের এক অন্য ভুবন।

নেহাৎ চাঁদ ফুলপাখি শুভদৃষ্টি ফুলশয্যা হয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ নয় আর পৃথিবী—  সাহিত্য সিনেমায় খুঁজছি বহুমাত্রিক শেড। সম্মানিত, পুরস্কৃত, প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সাহিত্যিক নিয়ে বিষম গোল বেঁধেছে মনে। প্রকৃত শিল্পী কী প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যাবেন না কী দাঁড়াবেন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে?

খ্যাতি রসে জরো জরো এলিট কবি লেখকরা প্রতিষ্ঠা আর প্রতিষ্ঠানের বোতলে আটকে, বোতলকেই বিশ্ব ভাবতে পারেন। সময় বড় নিষ্ঠুর। বাতিল বোতলকে ডাস্টবিনে ফেলতে দ্বিধা করবে না। ধেয়ে বিশ্বায়ন এলো। মুক্ত বাজার। অবাধ শিক্ষা। অবাধ বানিজ্য। অবাধ লেখনী। তাদেরকে পরিবেশনের জন্য ক্যাটারার। ক্যাটারারদের টেন্ডারের জন্য সিন্ডিকেট রাজ। তাদের পেছনে ছুটতে গিয়ে লেখা হারায় ধাপার মাঠে। কী একটা সুর বিন বিন করে মাথায় অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয়। কী এক বিপন্ন বিস্ময় … সঠিক ও যথার্থ শিল্প নির্মাণের জন্য শিল্পী সর্বদাই নিজেকে ভাঙবেন এবং এভাবেই তিনি সর্বদাই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এই বিপন্নতা। এই বিস্ময় …

এবং এই পাল্টে যাওয়া। প্রতিটি দিন বাজারের। প্রতিটি দিন সেলিব্রেশন। প্রতিটি দিন উপহারের মোড়ক খোলার DAY। মোড়কে মোড়কে মাটি আকাশ ঢেকে যায়। ছোটবেলায় যে ডাস্টবিন খুঁজে পাইনি—  গুঁড়ি মেরে সে কখন ঢেকে ফেলে পরিবেশ পরিচিতি।

গ

শিল্পীঃ বিজয় দাস

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। মুখ ঢেকে যায় প্রসাধনে। খুব ছোটোবেলায় স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মী দুই বোন শহরে বিখ্যাত ছিল ‘পেইন্টিং বক্স’ নামে—  খুব চড়া মেক-আপে অফিসে আসতেন তারা। এখন যে পাড়ায় থাকি কুড়ি বছর আগে সে তল্লাটে একমাত্র সুবলদার বউ ‘লিপস্টিক বউদি’ বলে পরিচিত ছিলেন—  ভোর পাঁচটায় মর্নিং ওয়াকেও কোনও সময় রঙ ছাড়া ঠোঁটে দেখা যায়নি তাকে। ঘন রঙ মাখা ঠোঁটে বৌদির সরল স্বীকারোক্তি—  ‘এমন অভ্যাস হয়ে গেছে, ভালো লাগে না গো’। আর এখন বরিন্দর গলগলে রোদে গলে পড়ছে আপামর সুন্দরীদের ঠোঁট চোখমুখ। রাঙামাটির পথের অজস্র শিমুল পলাশও যেন কনফিডেন্ট নয় নিজের পাপড়ি আর রঙ নিয়ে। ফেলে দেওয়া পাউচের স্তূপ থেকে খুঁজে নিচ্ছে বাতিল রঙের টিউব।

সেই যে ডাস্টবিন নেই কড়ি পাড়ার গল্প দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, কালক্রমে সে হয়েছিল সাজানো গোছানো এলিট পাড়া। সেই পাড়া ছেড়ে রেল লাইনের ওপারে খুব সস্তার জমি, কিনলাম। পুকুর-কাশফুল-ইটভাটা-শ্যাওড়া খেঁজুর গাছ—  সে তেপান্তর দেখে উদ্বাস্তু কলোনি থেকে এলিট হয়ে যাওয়া পাড়া হায় হায় করে উঠেছিল। পাঁচ-ছ কাঠা জমি নিয়ে এক একটা বাড়ি কলোনির তখনও বোঝেনি আত্ম প্রতিষ্ঠায় মুছে যাবে আত্মপরিচয়। ভিটে বেচেই টিকে থাকতে হবে ৬০০-৭০০ স্কোয়ারফিটের কংক্রিটের বস্তিতে। আমাদের নতুন ফাঁকা পাড়াতেও তাই। প্রথমে বেঁধে বেঁধে থাকার প্রয়াস। দ্রুত পুকুর টুকুর বুজিয়ে একতলা বাসগৃহের দোতলা তিনতলা হয়ে যাওয়া। বাড়ির মালিক থেকে ক্রমে ভাড়া বাড়ির মালিক হওয়ার আত্মতৃপ্তি। মুখোমুখি দেখা হলে, কথা বলার সময় না থাকলেও, দুগ্গাপুজো, কালীপুজো থেকে ক্রমে ক্রমে শনি গণেশ লোকনাথ পুজো ঘিরে কৌম হওয়ার উদযাপন আছে। সংস্কৃতিতো কোনও ভুস্ করে ভেসে ওঠা স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার নয়, সামাজিক ব্যাপার।

পুরনো পৃথিবীর পাঠক্রমে, যা যা রুচিহীন জেনেছি—  লোক দেখানো আচরণ, বড়লোকি দেখানো মনোভাব, দীনদরিদ্রকে বৈভব দেখানোর কালচার—  এইসব কিছুই সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়ে যত্রতত্র যা খুশি করার ছাড়পত্র পেয়ে গেল। নিজস্ব রুচির মান দিয়ে বাঁধা সংস্কৃতি রইল না। বিড়ালের বিয়ে দিয়ে বৈভব প্রকাশের ফর্ম পাল্টে এলো DAY CELEBRATION-এর নানা ফর্ম। এইসব হ্যা হ্যা উন্মাদনার একমাত্র লক্ষ্য দগদগে বৈভব প্রদর্শনে ঈর্ষা কাতর প্রতিবেশীর বুকে ঈর্ষার সবুজ দৈত্যকে চড়িয়ে দেওয়া। বাজারের গ্রুমিং মতো ভালো বউ, ভালো বাবা, ভালো মা হওয়ার যে প্যাকেজিং; জীবনের ওঠাপড়া গায়ে না লাগার যে বুদ্বুদ সুরক্ষা—  তা এমনই স্বর্গীয় মোহময় যে এর বাইরের পৃথিবীকে কেমন ডাস্টবিন মনে হয়। অভাব দৈন্য অনাহার উচ্ছেদ জলজমি কারখানা শোষণ বঞ্চনা নিয়ে কারা এরা ভাতরুটির জন্য চ্যাঁচ্যায়—  ! এত নোংরা আবর্জনার মতো মানুষ, এইজন্যই না শীততাপ নিয়ন্ত্রিত পার্কের মতো পৃথিবী চাই। আমরা কিছু দেখব না কিন্তু আমাদের মিনিটস্ ডিটেলস্ দেখো তোমরা। দেখ আমার ড্রেস মেটারিয়াল ঘর বাড়ি আসবাব গয়নাগাটি বেডরুম টয়লেট। আমার প্রেম দেখো। হানিমুন দেখো। দেখাবার মতো হলে প্রাইভেট কিছু নেই সব পাবলিক। আমাদের যাপন ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো’ অন দ্য আর্থ। এই শো-বিজনেসে পৃথিবী আই মিন্ ওয়ার্ল্ড ডার্টি ডাস্টবিন হলে, স্যরি ওল্ড হ্যাগ, উই হ্যাভ টু লীভ্, অন্য গ্রহের ভালো অফার আছে …।

সমাপ্ত
তৃপ্তি সান্ত্রা – “ ডাস্টবিনের জন্য ” ১
সুমনজিৎ চট্টোপাধ্যায় – “ পোষা ডাস্টবিন ”
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India