যুদ্ধ বোধহয় আর ঠেকানো গেল না। অনেকদিন ধরেই ভেতরে ভেতরে ঠাণ্ডা লড়াই চলছিল। ঠারেঠোরে কথা, নাম না করে বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি, তারপর হুমকি, হুঙ্কার, তর্জন-গর্জন, এরপরো অনেকে আশা করেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সম্মিলিত গ্রহসংঘের বৈঠক থেকে যখন লাল চাকতি আর নীল চাকতি— এই দুই গ্রহের গ্রহপতিরা মুখ কালো করে বেরিয়ে এলেন তখন সে আশাটুকুও নিভে গেল। গ্রহসংঘের প্রধান আনি-বানি-জানি-না, যাঁকে আড়ালে সবাই ঘণ্ট বলে ডাকে, কারণ যিনি যেকোন আলোচনাকে ঘণ্ট পাকিয়ে সরল বিষয়কে জটিল করে তুলতে ওস্তাদ, তিনি ভিজে বেড়ালের মতো মুখ করে প্রেস মিটে বললেন ‘আপনাদের কারো কাছে মাথা ধরারা বাম আছে? বড্ড মাথা ধরেছে। যাই বাড়ি গিয়ে চাড্ডি গেঁড়ির ঝোল খেয়ে ঘুমোই’ সব সৌরজগতের তাবড় তাবড় সাংবাদিকরা তো হাঁ! কিন্তু তারা এরপর হাজার চেষ্টা করেও আনি-বানি-জানি-না র মুখ থেকে একটা কথাও বার করতে পারল না। প্রেস মিট থেকে বেরিয়ে তিনি সোজা চলে গেলেন সাইপ্রাস সান্তারা নামের এক ছোট্ট গ্রহে ছুটি কাটাতে। ব্যস, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে কী কী কথা হল, যুদ্ধ হবে কি হবে না তা সোজাসুজি জানার কোন উপায়ই রইল না। বাধ্য হয়ে কড়া নজর রাখা হল দুই গ্রহের ওপর। তারা কী বলছে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে কিনা, বিদেশি আসার ওপর কড়াকড়ি হচ্ছে কিনা এসব খুঁটিয়ে দেখা হতে লাগল। আর সেসবের ভিত্তিতেই মহাবিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুরতে লাগল একটাই ফিসফিসিনি— যুদ্ধটা এবার হচ্ছেই।
অথচ খুবই সামান্য একটা ব্যাপার। ময়লার বালতি! ডাস্টবিন! গত ১০০ বছর ধরে লাল চাকতি, নীল চাকতি ও অন্যান্য গ্রহপুঞ্জের যে সমস্যাটি সব গ্রহপতিদের মাথাব্যাথার মুখ্য কারণ হয়ে আছে, তা হচ্ছে ময়লা কোথায় ফেলা হবে। এ ব্যাপারে পৌরাণিককালে বাড়ির গিন্নিরা যা করতেন, অর্থাৎ এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপি চুপি রাস্তায় ফেলে দেওয়া, তাবড় তাবড় গ্রহগুলিও অবিকল তাই করত— সব বর্জ্য গোল্লা পাকিয়ে মহাকাশে ছুঁড়ে দেওয়া। আগেকার দিনে মহাকাশের রাস্তা প্রচুর ফাঁকা ছিল, এত নভোযান চলত না, প্রাইভেট স্পেসজেট তো ছিলই না, তখন এ নিয়ে খুব বেশি সমস্যা হয়নি, গোল্লা পাকানো ময়লা আরেকটা উপগ্রহের মতো গ্রহটির চারপাশে ঘুরতে থাকত। কিন্তু এখন মাটিতে চলা গাড়ির তুলনায় আকাশগাড়ি বেশি, প্রাইভেট স্পেসজেটের তো ছড়াছড়ি। আন্তঃগ্রহ চলাচল অনেক বেড়ে গেছে। আগেকার লোক যেমন চুঁচড়ো বা বনগাঁ থেকে কলকাতায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করত, তেমনি এখন অনেক লোক পৃথিবী থেকে মঙ্গল বা চাঁদ থেকে নীল চাকতিতে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে। আর তার ফলে সেই ময়লার গোল্লাগুলির সঙ্গে নিত্য কলিশন, দুর্ঘটনা। স্বচ্ছ গ্রহ নীতি, অনেক সচেতনতা অভিযান, হ্যানা ত্যানা করেও কিস্যু হল না। সবচেয়ে যেটা মুশকিল কোন গ্রহেই এতটুকু বাড়তি জায়গা পড়ে নেই যেখানে ময়লা ফেলা যায়। প্রাচীনকালে পৃথিবী গ্রহে কলকাতা নামক একটি জনপদ ছিল, সেখানে ধাপার মাঠ ছিল বিখ্যাত ময়লা ফেলার জায়গা। সরকারিভাবে সেখানে ময়লা ফেলার কথা, কিছু-কিছু ফেলাও হত, কিন্তু ইতিহাস বলছে পুরো জনপদটিই ছিল সম্প্রসারিত ধাপার মাঠ। ওখানকার বাসিন্দাদের নাকে কাপড় ঢেকে চলাফেরা অভ্যেস হয়ে গেছিল, তাই কলকাতাকে অনেকে ঢাকা বলে ভুল করত। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ঢাকা আবার কী? এটি আর একটি জনপদ, এর বেশি কিছু এই কাহিনীতে প্রাসঙ্গিক নয়। মোদ্দা কথা হল ধাপার মাঠ এখন একটি অসম্ভব রূপকথা। এখন কোন গ্রহেই ওই জায়গা ময়লা ফেলার জন্য বরাদ্দ করা সম্ভব নয়। বেশ কিছু বছর এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা, গোলটেবিল, দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ইত্যাদি চলবার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত হল নিউ স্টার গ্রহাণুটা তো খালিই পড়ে আছে, ওতেই আপাতত ময়লা ফেলা যাক। অবশ্য সবাই নয়, আপাতত দুটি গ্রহ এখানে ময়লা ফেলতে পারবে, ডিজিটাল সিলেকশনের মাধ্যমে গ্রহদুটির নাম ঠিক হল— লাল চাকতি আর নীল চাকতি। তাহলে বাকি গ্রহগুলো কি বানের জলে ভেসে এসেছে? এমন প্রশ্ন ওটা স্বাভাবিক, উঠলও। সম্মিলিত গ্রহসংঘ করজোড়ে জানালেন সব গ্রহের জন্যেই খালি গ্রহাণুর খোঁজ চলছে, দয়া করে একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। অপেক্ষা? তা কতদিন? সে ব্যাপারে সম্মিলিত গ্রহসংঘ কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। দেবেন কীভাবে? খালি গ্রহাণু কোথায়? বেশিরভাগই কোন না কোন সরকারি কাজে লিজ নেওয়া আছে। কোনটা অস্ত্র কারখানা, কোনটা রিসর্ট, কোনটা ক্রেশ, কোনটা গণ বিনোদন কেন্দ্র। বাকি গুলো কোন না কোন গ্রহ জবরদখল করে বসে আছে। সে তবু ভাল। বাদ বাকি গুলোর অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে নানারকম গ্রহসংঘবিরোধী, অ-গ্রহসামাজিক কাজকর্ম চলে, এর পেছনে গ্রহসংঘের কয়েকজন কর্তাব্যাক্তির প্রচ্ছন্ন মদত আছে বলে শোনা যায়। তাই সেসব গ্রহাণু খালি করা মোটেই সোজা কথা নয়, সর্ষেই মধ্যেই যেখানে ভূত! আনি-বানি-জানি-না র এমন ফাঁকা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অন্য গ্রহগুলো কিন্তু, কি আশ্চর্য, বিশেষ চেঁচামেচি করল না। তার একটা কারণ হয়তো তারা দেখতে চাইছিল, এভাবে একটা গ্রহাণুতে ভাগাভাগি করে আবর্জনা ফেলার প্রকল্পটা সত্যি সফল হয় কিনা। এছাড়া তারা সেই মুহূর্তে আর একটা মহাকাশযুদ্ধের দায় নিতে রাজি ছিল না।
প্রথমে ব্যাপারটা ভালোভাবেই শুরু হল। লাল চাকতি আর নীল চাকতি শান্তিপূর্ণভাবেই নিউস্টারে ময়লা ফেলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন কী হল, লাল চাকতির ময়লাগাড়িকে বাধা দেওয়া হল, ফিরিয়ে দেওয়া হল। মজার ব্যাপার যারা বাধা দিল তারা নিউ স্টার পুলিশ নয়, নীল চাকতির নাগরিকও নয়, একদল রোবো-মাফিয়া। এদের ভয় করে না এমন লোক এই ভু-চরাচরে নেই। এরা প্রথম দিন বাধা দেবে, দ্বিতীয় দিন লোপাট করে দেবে। এমন প্রোগ্রামড। তাদের বাধা পেয়ে ময়লা ভ্যান পত্রপাঠ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এল। রেগে আগুন হয়ে গেলেন লাল চাকতির গ্রহপতি রক্তিম লালা। এটা পরিষ্কার যে নীল চাকতি ওই রোবোগুলোকে সুপারি দিয়েছে। পুরো নিউ স্টারকে তারা একাই দখল করতে চায়। ময়লা টয়লা সব বাজে কথা ওরা এখানে একটা বেআইনি অস্ত্র কারখানা খুলতে চায়। ঠারেঠোরে নয়, একেবারে অল প্ল্যানেটস প্রেস মিট ডেকে নাম করেই তিনি অভিযোগ আনলেন নীল চাকতির বিরুদ্ধে।
ব্যস! আগুনে একেবারে ঘি পড়ল। ঘি শব্দটা বুঝতে অবশ্য এখনকার বাচ্চাদের অসুবিধে হবে। আমি বলি কি, একবার কুকিং আরকাইভ গুলো ঘুরে দেখো, তাহলেই তোমরা বুঝতে পারবে কাকে বলে ঘি। রেসট্রিকটেড প্লেস ছাড়া আগুনও সবজায়গায় দেখা যায় না। যাইহোক আগুনে ঘি যখন পুরাকালে পড়ত, তখন যেমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠত, লাল চাকতির বিবৃতি শুনে নীল চাকতির গ্রহপতি সুনীল ব্লুম তেমনি জ্বলে উঠলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মানহানির মামলা ঠুকে দিতেন যদি না সেই মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী পাশ থেকে মনে করিয়ে দিতেন হপ্তায় হপ্তায় তিনি লাল চাকতিতে বডি স্পা করাতে যান, ওখানে রেটটা সস্তা, পরিষেবাও ভালো। এসব মামলা টামলা বাধলে মাঝখান থেকে তাঁর স্পা করানো বন্ধ হয়ে যাবে। নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে সুনীল তাঁকে কিছুতেই লাল চাকতিতে যেতে দেবেন না। আসল ব্যাপারটা অন্য। সেটা নীলিমা ব্লুম মানে সুনীলের স্ত্রীর ওই নাম, তিনি ছাড়া কে জানবে। সুনীল হচ্ছেন মহাকিপটে। যেকোনো অজুহাতে তিনি বৌ-বাচ্চার খরচ কাটছাঁট করতে চান। শুধু কি স্পা, তাঁদের বড় ছেলে নীলাব্জর প্রাইভেট টিউশনও তো ওই লাল চাকতিতে। আসলে অস্বীকার করে লাভ নেই, নীল চাকতি এখনো একটা উন্নয়নশীল গ্রহ। আধুনিক জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় প্রায় কিছুই সেখানে মেলে না। হায়ার স্টাডিজ তো দূরের কথা, স্কুলিংও বেশিরভাগ সময় অন্য গ্রহে করতে হয়। চাকরি বাকরির তেমন কোন সুযোগ নেই। আশ্চর্য কি, বেশিরভাগ ছেলেপিলে বখাটে মেরে যাচ্ছে। নীলিমার খুব মনে হচ্ছিল, সুনীল যতই রাগ দেখান, নিউ স্টারে গণ্ডগোল তিনিই বাধিয়েছেন, ওখানে বেআইনি অস্ত্র কারখানা থাকার কথা তিনি বিলক্ষণ জানেন। জেনে চুপ করে আছেন কারণ এতগুলো বেকার ছেলেকে চাকরি দিতে পারার ক্ষমতা তাঁর নেই বলে। নীলিমা গম্ভীর মুখে ন্যানো ব্রাশ দিয়ে নখে নখপালিশ লাগাতে লাগাতে বললেন ‘খবরদার অমন কাঁচা কাজ করো না। আমার স্পা বা নীলুর টিউশন না হয় ছেড়ে দাও, আমাদের কাঁচা বাজারও তো লাল মেগা মার্ট থেকে হয়। ওখানকার শ্যাওলার চচ্চড়ি দিয়েই তো তুমি একথালা ভাত খাও গো’।
ক্রমশ প্রকাশ্য...