আবেদনের পর আবেদনে সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জর ডেস্ক ভরে উঠেছে। অনেকদিন ঘাপটি মেরে থাকার পর একটু শান্ত পরিবেশ দেখে আনি-বানি-জানি-না অজ্ঞাতবাস ছেড়ে দপ্তরে ফিরেছেন। আসলে তিনি গিয়েছিলেন সাইপ্রাস সান্তারার এক বিলাসবহুল রিসর্টে। এসেই চিঠির স্তূপ দেখে তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। প্রথমে আঁতকেই উঠেছিলেন। এত দামী কাগজ নষ্ট করে চিঠি লিখেছে সবাই! এখনকার দিনে কাগজ নষ্ট করা এক গর্হিত অপরাধ। কিন্তু এতজন মিলে অপরাধ করলে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যাবে, তা ভাবতেই তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। আজকাল কাজের নামে গায়ে জ্বর আসে আনির। ইচ্ছে হয় লুনাটিক রিসর্টে জলের ধারে শুয়ে শুয়ে পুরোনো পুঁথিপত্র পড়েন আর হরিদাসের বুলবুলভাজা খান। হরিদাসের বুলবুলভাজা বলে যে বস্তুটি চাঁদে বিক্রি হয়, সেটি আদপে সেই খাঁটি বুলবুলভাজা নয় যদিও। তবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ছাড়া আর কী-ই বা করার তাঁর? যাই হোক একটি চিঠি চোখের সামনে তুলে ধরে তিনি দেখলেন না, কাগজ নয়, কৃত্রিম তন্তু, দেখতে অবিকল কাগজ যদিও। তাঁর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। যাক কাউকে সাজা-টাজা দিতে হবে না। কিন্তু এত চিঠি বসে বসে পড়তে হবে নাকি? সে কাজটিও সহজ করে দিল তাঁর দক্ষ সচিব কুমারী চটপটা। সে মিষ্টি হেসে জানাল যে সব স্ক্যান করে রেখে দিয়েছে। সব চিঠিই এসেছে লাল চাকতি ও নীল চাকতির সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে। তাদের বক্তব্য প্রায় এক। এ বছর তাদের বর্ষা মকুব করতে হবে। কারণ নিউ স্টার সিল করে দেওয়ায় কেউ আর ময়লা সেখানে ফেলতে পারছে না। সব যে যার বাড়ির সামনেই জমা করছে। এ অবস্থায় বৃষ্টির কল চালালে কী যে বিশ্রী ব্যাপার হবে … ইত্যাদি ইত্যাদি।
নিজের ঘরের দোলনা চেয়ারে দুলতে দুলতে হেসে বাঁচেন না আনি-বানি-জানি-না। কী একটা কাজে বসের ঘরে ঢুকে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন কুমারী চটপটা। ‘দিব্যি খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে / একলা বসে ঝিমঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন ক্ষেপে!’
ব্যাপারখানা কি? স্যারের মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? চটপটাকে অমন অবাক চোখে চেয়ে থাকতে দেখে আনি-বানি-জানি-না দুলুনি থামিয়ে বললেন, ‘কেসটা কী বলো তো? ফি বছর এক্সট্রা রেন অ্যালাউন্স চেয়ে চিঠি আসে, বর্ষা উৎসব, বর্ষা মেলা, উদ্বোধন করতে করতে হাঁপিয়ে যাই, এবার হলটা কী?’
‘আজ্ঞে স্যার’ বলে স্ক্যান করা চিঠির বক্তব্য আবার গড়গড় করে বলতে শুরু করে চটপটা। এতক্ষণে কানে কিছু ঢোকে আনি-বানি-জানি-না র। লাল চাকতি, নীল চাকতি, নিউ স্টার, ময়লা ফেলা শব্দগুলো শুনতে শুনতে তিনি খাড়া হয়ে বসেন, তারপর চেয়ার ছেড়ে ঘরে পায়চারি করতে শুরু করে দেন। উঃ ফির ওহি পুরানা মুসিবত। কোথায় তাঁর অনুপস্থিতিতে আপনা আপনি সব মিটমাট হয়ে যাবে, তা না আরো ঘোঁট যে পাকিয়েছে, তা চটপটার কথা থেকে পরিষ্কার। নিমপাতার মতো মুখে ফাইলপত্র ঘাঁটতে শুরু করেন আনি-বানি-জানি-না। তারপর গম্ভীরমুখে বলেন ‘নীল চাকতি তো দেখছি বেমালুম সব অস্বীকার করেছে। বলছে ওরা কোন লোক পাঠায়নি’।
‘হ্যাঁ স্যার কথাটা মিথ্যে নয়। নীল চাকতির লোকও ময়লা ফেলতে গিয়ে একইরকম বাধা পেয়েছে’ আনি-বানি-জানি-না বলেন, ‘হুম। ইন্টারেস্টিং। তা কারা এ কাজ করছে কিছু জানা গেছে?’
কুমারী চটপটা জরুরি পয়েন্টস ভুলে না যাওয়ার জন্যে চিরকুটে লিখে রাখে। সে তার জামার পকেট থেকে তেমন একটা চিরকুট লিখে বার করে বলল, ‘তেমন কিছু না স্যার। নিউ স্টার সিল করে দেওয়ায় আর কিছু জানা যাচ্ছে না। তবে ইন্টারস্পেসপোল নিজেদের মতো করে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ওঃ’ হঠাৎ ঝলমল করে ওঠে চটপটার মুখ। সেটা চোখ এড়ায় না আনি-বানি-জানি-না র।
‘কী হল? এত উৎফুল্ল হবার কী কারণ ঘটল হঠাৎ?’
‘স্যার! মনে পড়েছে। আজই তো ইন্টারস্পেসপোলের প্রথম কিস্তির রিপোর্ট সাবমিট করার কথা’।
‘কোথায়? এখানে আসবে না তো?’ আঁতকে ওঠেন আনি। সবে ছুটি থেকে ফিরে হাজার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, ভিড়ভাট্টা ভাবতেই শিউরে ওঠেন তিনি।
চটপটা তাঁকে আশ্বস্ত করে বলে ‘ডোন্ট ওরি স্যার। স্পেস কমিউনিটি সেন্টারে হবে ব্যাপারটা। দাঁড়ান, ওয়ালনেট চালিয়ে দিচ্ছি। সরাসরি দেখানোর কথা’।
বলেই সামনের দেওয়ালে আঙুল ছোঁয় চটপটা, আর অমনি চালু হয়ে যায় টাচ স্ক্রিন ওয়ালনেট। ইন্টারস্পেস পোলের অধিকর্তা পোল্যান্ডো গম্ভীর মুখে হাতে ধরা নথি থেকে পড়তে থাকেন ‘আপনারা শুনে খুশি হবেন নিউ স্টারে গণ্ডগোলের পাণ্ডারা ধরা পড়েছে। সুখের এবং স্বস্তির কথা এরা কেউ নীল বা লাল চাকতির লোক নয়। কিন্তু এই বা অন্য সৌরজগতের কোন গ্রহেরও এরা বাসিন্দা নয়’। এই পর্যন্ত বলে পোল্যান্ডো একটু থামলেন। কমিউনিটি সেন্টার জুড়ে ফিসফিসিনি শুরু হয়ে গেল। তাহলে এরা কারা? পোল্যান্ডো কি কোন আষাঢ়ে গল্প শোনাতে সবাইকে এখানে ডেকেছেন? রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা ভেঙে আবার পড়তে শুরু করেন পোল্যান্ডো। ‘এটা কোন মামুলি অপরাধের ঘটনা নয়। এ একটা দেশ গ্রহ এমনকি কালের সীমানা লংঘন করা চক্রান্ত’।
‘মানে?’ এবার আনি-বানি-জানি-না উঠে দাঁড়ান উত্তেজনায়। পোল্যান্ডো বলে যান ‘যাদের আপনারা রোবো মাফিয়া বলে জানেন তারা কেউ রোবো নয়, এরা প্রাচীন মানুষ হোমো স্যাপিয়েনস, যারা পৃথিবী নামক গ্রহটিতে থাকত। আরো বিশদে বললে এরা ছিল ভারতবর্ষ নামের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামের বাসিন্দা। এদের সময় ভারত সাফাই অভিযান চালু হয়েছিল, গ্রামের রাস্তা ঘাট টয়লেট ইত্যাদি পরিষ্কার রাখার ডাক দিয়ে। কয়েকটি গ্রামের মোড়ল তাতে কর্ণপাত করেনি। সর্বকালে সর্বযুগেই এরা আছে। নোংরার মধ্যে এরা ভালো থাকে, পরিষ্কার হাওয়ায় এদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়’।
হঠাৎ একটি কচি কণ্ঠে প্রশ্ন শোনা যায় ‘এরা কি তাহলে ভূত?’
পোল্যান্ডো হেসে বলেন, ‘ভূত মানে যদি অতীত হয়, তা হলে এরা ভূত। আসলে তিন হাজার বছর আগে থেকেই প্রতি মুহূর্তে টাইম-মিরর ইমেজ তুলে রাখার ব্যবস্থা চালু হয়। ব্যাক্তিগত ক্যামেরায় তো বটেই, রাষ্ট্রের উদ্যোগেও। এই ইমেজ থেকে এরা অনেকসময় সময় সীমান্ত পার হয়ে চলে আসে। এরা যেমন এসেছে’।
বৈঠক শেষ। ওয়ালনেটে দেখা গেল রক্তিম লালা আর সুনীল ব্লুমের উষ্ণ করমর্দনের ছবি। পেছনে একঝলক নীলিমাকেও দেখা গেল, মুখে চওড়া হাসি। স্বাভাবিক। লাল চাকতির স্পাতে যেতে কোন বাধা রইল না, স্বামীর পাতে রোজ শ্যাওলার চচ্চড়িও তুলে দিতে পারবেন আগের মতো। আনি-বানি-জানি-নারও তো খুশি হওয়া উচিত, দুই গ্রহের ঝামেলা মেটানোর কাজ ঘাড় থেকে নামল। তাঁর স্বপ্নের বর্জ্য গ্রহ প্রকল্পের প্রাথমিক ধাপ সফল। এখন তাঁর আবার অখণ্ড অবসর। চাঁদে গিয়ে হরিদাসের বুলবুল ভাজা খেতে পারবেন ইচ্ছেমতো। কিন্তু খুশি হতে পারছেন কই? তাঁর ঘাড়ের কাছে কারা যেন ভেজা ভেজা নিঃশ্বাস ফেলছে। একবার যখন সময়-সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে, এত সহজে ওরা ফেরত যাবে না। আর কী কী দুর্ভোগ কপালে লেখা আছে কে জানে। ফোঁস একটা নিঃশ্বাস পড়ে আনি-বানি-জানি-না র।
সমাপ্ত