রাহুল দাশগুপ্ত – “ ডাস্টবিন ”

বিভাগঃ স্যাটায়ার

একটা সময় গোটা দুনিয়ায় এই শহরটার খুব নামডাক ছিল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন।

 বৃদ্ধের বয়স গত মাসে সত্তর ছুঁয়েছে। স্ত্রী সবে বাহান্ন। দেখে আরও কম বয়স মনে হয়। দুনিয়াটা তাঁর চোখে এখনও রঙিন। এয়ারপোর্টে দু-ঘণ্টা সময় ফালতু না কাটিয়ে শহরটা ঘুরে দেখার বায়নাটা তারই।

বৃদ্ধ ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক। এই শহরের নাড়িনক্ষত্র তিনি জানেন। শহরটা এক সময় উপনিবেশের কেন্দ্র ছিল। এখন এটাকে একটা ‘মৃত শহর’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

স্ত্রী বলেছিলেন, আমি কোনওদিন মৃত শহর দেখিনি। চলো না, সময় তো আছে। একটু ঘুরে দেখি।

 স্ত্রীর কথায় বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেছিলেন। এটাই তাঁর স্বভাব।

স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, এই দুনিয়ায় মৃত শহর কী অনেক?

অনেক। বৃদ্ধ মৃদু হেসে বলেছিলেন।

 তাঁদের গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছিল একটা ফুলের বাগানের সামনে। বৃদ্ধ বলছিলেন, এই বাগানের একটা ইতিহাস আছে।

বৃদ্ধ বাগানটির ইতিহাস বলছিলেন। স্ত্রী তাকিয়ে ছিলেন সামনের সরোবরের দিকে। স্বচ্ছ জল তার। সেই জলে ফুটে আছে নানা রঙের পদ্ম। দূরে, সরোবরের ধারে, পরপর অনেকগুলো লরি দাঁড়িয়ে। সেগুলোর গায়ে অসম্ভব নোংরা।

স্ত্রী জানতে চাইলেন, ওই নোংরা লরিগুলো এখানে কেন?

এই সরোবরটা বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গোটা বাগানটাই ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। বৃদ্ধ বলে উঠলেন।

কেন? স্ত্রী চমকে উঠলেন। তারপর বললেন, তুমি যে বলেছিলে, এই বাগানটাই গোটা শহরের ফুসফুস?

বৃদ্ধ মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, মৃতের আবার ফুসফুসের প্রয়োজন কী? সে কী শ্বাস-প্রশ্বাস নেবে?

স্ত্রী সামনের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। তাঁর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। জানতে চাইলেন, কেন? কেন ধ্বংস করে দেওয়া হবে প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টিকে?

কারণ, বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন, এখানে একটা শপিং মল হবে। জীবন্ত, সতেজ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বদলে মৃত, শৌখিন পণ্যদ্রব্যে ভরে দেওয়া হবে জায়গাটা…

এরা কী গোটা শহরটাকেই বাজার করে ছাড়বে?

ছাড়বে নয়, ছেড়েছে। বৃদ্ধ হাসলেন। আর তুমি তো জানোই, বাজারের ধর্ম বলো, নীতি বলো, সত্য বলো, দর্শন বলো, সবই এক। আর তা হলো, কেনাবেচা। বাজার সবসময়ই কেনাবেচায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। এর বাইরে ভাবতেই পারে না। বাজারের মন নেই, হৃদয় নেই, রুচি নেই, আত্মা নেই, সংস্কৃতি নেই, বিবেক নেই, মস্তিষ্ক নেই। বাজার শুধু বোঝে, মুনাফা। লাভ। বাজারের শুধু একটাই স্বভাব, একটাই প্রবৃত্তি, আর তা হলো, লোভ। সীমাহীন লোভ। বস্তুর প্রতি লোভ, অর্থের প্রতি লোভ, সুবিধার প্রতি লোভ, শরীরের প্রতি লোভ। সম্পর্কের মধ্যেও এরা শুধু মুনাফা খোঁজে, লাভ-লোকসান খোঁজে, উষ্ণতা খোঁজে না। মানুষকে এরা বিচার করে তার চেয়ার দিয়ে, তার মেধা বা যোগ্যতা দিয়ে নয়। সেখানেও শুধু স্বার্থ আর লাভ-লোকসান নিয়েই ভাবে। মুনাফার প্রতি, ছোটো ছোটো স্বার্থের প্রতি, লাভের প্রতি সীমাহীন লোভই এদের বিকৃত করেছে। পচে, গলে গেছে গোটা শহরটা। সেই পচা, গলা, মৃত শহরটাকেই এখন তুমি দেখছো…

কিন্তু মৃত্যু একটা শহরকে কী দিতে পারে?

বৃদ্ধ এবার হো হো করে হেসে ওঠেন। তারপর বলেন, অন্ধতা।

স্ত্রী শিউরে ওঠেন। জানতে চান, অন্ধতা?

ঠিক তাই, অন্ধতা। মৃত্যু মানে অন্ধকার। আলো সেখানে থাকতে পারে না! একটা মৃত শহর স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্ধতাকে অভ্যর্থনা জানায়। ইতিহাসের দিক দিয়ে দেখলে…

কিন্তু এই মৃত্যু তো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এ তো হত্যা…

তুমি বলছো, খুন? সে তো প্রতারকরা বলে! তাদের ভাষায়, ওরা বাইরে থেকে এসে আমাদের খুন করে গেছে। না, না। আমার তো মনে হয়, আত্মহত্যা। আমি বলব, তোমরা খুন হতে দিলে কেন? তোমরা ঘুমিয়ে ছিলে? তোমরা ওদের অভ্যর্থনা করোনি? ওদের খাতির-যত্ন করোনি? ওদের ফিসফিসানি শুনে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরোন? একে অপরের শরীরে চাবুকের দাগ বসিয়ে দাওনি? তোমরা সংখ্যায় ছিলে অগণিত। ওরা ক’জন ছিল? তোমরা চাওনি, কেউ এসে তোমাদের হত্যা করে যাক? মৃত্যুর বীজ তোমরা নিজেরা বহন করোনি? তাহলে এটা কী আত্মহত্যা নয়? তোমরা যা চেয়েছিলে, তোমাদের সম্মতি নিয়ে, ওরা সেটাই করেছে। তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করেছো। হত্যা করে চলেছো। আর হত্যাকারীর নাম জানতে চাইলে, ওদের হাত খুঁজছো আর লুকিয়ে ফেলছো নিজেদের হাত! যতদিন এই আত্ম-প্রবঞ্চনা থাকবে, ততদিন এই আত্মহত্যা চলতেই থাকবে…

তুমি কী বলতে চাও?

একটা মৃত শহরকে কীভাবে চেনা যায়, জানো? বৃদ্ধ বললেন, তার চোখ দিয়ে। একটা মৃত শহরের কোনও চোখ থাকে না। চোখের বদলে শুধু থাকে দু’টো বড়ো বড়ো অন্ধকার গর্ত।

কেন?

কারণ, একমাত্র চোখই পারে আলোকে অভ্যর্থনা জানাতে। আর আলোই তো পারে রুচি, মেধা, বিবেক, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে। একটা জীবিত শহর অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। ছোটো ছোটো স্বার্থের জন্য ভবিষ্যতের মঙ্গলকে বিসর্জন দেয় না। আর এই মঙ্গলকে দেখতে পায় বলেই তারা মানুষের জন্য, দেশের জন্য, মনুষ্যত্বের জন্য ভাবে, কিছু করার চেষ্টা করে, নিজেদের শুভবোধকে জিইয়ে রাখে, নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখে। কিন্তু মৃত শহরের তো চোখ নেই! শুধু অন্ধকার গর্ত আছে। সেই গর্তের অন্ধকারে আছে স্বার্থ, হীনতা, লোভ, নীচতা, কুরুচি, বিকৃত, সংকীর্ণতা, হিংসা, ঈর্ষা, দলাদলি। এখানে সবাই সবাইকে ঠকাচ্ছে। সবাই সবাইকে প্রতারিত করছে। সবাই সবাইকে টপকে উপরে উঠতে চাইছে। সবাই সবাইকে দুমড়ে-মুচড়ে-থেঁতলে দিয়ে নিজে এগিয়ে যেতে চাইছে। সবাই সবার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। সবাই সবার বেঁচে থাকাকে সঙ্কুচিত করে দিতে চাইছে। ছোটো ছোটো লাভ, ছোটো ছোটো মুনাফা, ছোটো ছোটো সুখ, ছোটো ছোটো জয়, ছোটো ছোটো প্রতিহিংসা, ছোটো ছোটো প্রচার, ছোটো ছোটো ক্ষমতা, ছোটো ছোটো আরাম, বড়ো করে কিছু ভাবতেই পারে না এরা, দূরের কিছু দেখতেই পারে না। সংকীর্ণ জায়গায় নিজেদের সঙ্গে নিজেরা চালাকি করে জীবনটাকে এরা কদর্য করে তুলেছে। গোটা শহরে ছড়িয়ে রেখেছে রক্ত, থুতু আর শ্লেষ্মার দাগ। বাতাসটাকে এরা ঘোলাটে করে দিয়েছে আর দুর্গন্ধে ভরিয়ে তুলেছে। কিন্তু এইসব করে শেষপর্যন্ত কোথায় পৌঁছবে এরা?

একটা মৃত শহরে শ্মশানে ছাড়া কোথাও পৌঁছানো যায় না…

সময় হয়ে গেছিল। ওরা এয়ারপোর্টে ফিরে এলেন। ঠিক ঢোকার মুখেই, বিরাট একটা ছবি। পরপর পাশাপাশি পাঁচটি মুখ।

বৃদ্ধ বললেন, এরা কারা জানো?

কারা? স্ত্রী জানতে চাইলেন।

এই পাঁচজনে মিলে এই শহরটাকে কিনে নিয়েছেন। এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত ধনী, পুঁজিপতি, শিল্পপতি। কীসের ব্যবসা এদের?

বাঁ-দিক থেকে ডানদিকে এসো। প্রথমজন পণ্যদব্য নিয়ে, দ্বিতীয়জন রাজনীতি নিতে, তৃতীয়জন ধর্ম নিয়ে, চতুর্থজন শিক্ষা নিয়ে এবং পঞ্চমজন স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা করেন।

এরাও কী চান না, শহরটা আবার বেঁচে উঠুক?

পাগল হয়েছো! বৃদ্ধ হো হো করে হেসে উঠলেন আবার। তারপর বললেন, জীবিত শহরে ব্যবসা জমে না কী?

চক্ষুহীন, অজ্ঞান, অন্ধকার, মৃত শহরেই তো ওসব…

আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেছিল বিমানটি। বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, শহরটাকে এখনও দেখতে পাচ্ছো?

শহর কোথায়? স্ত্রী ঝটকা দিলেন, ওখানে তো একটা ডাস্টবিন…

illustration_04ো

শিল্পীঃ সুদীপ চক্রবর্তী

সমাপ্ত
সত্যপ্রিয় ঘোষ – “ দোলনা ”
বাসব দাশগুপ্ত – “ দুটি কবিতা ”
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address