দয়াময় মাহান্তী – “ সম্পর্ক ”

বিভাগঃ গদ্য
Dayamay Mohanty.png

শিল্পীঃ শান্তনু গাইন

উপনিষদ জগৎ সৃষ্টির কারণ হিসেবে ব্রহ্মের একা থাকতে না-পারাকে উল্লেখ করেছেন।এই অসীম শূন্যে একা থাকতে ভয় পেয়ে তিনি মায়ার জগৎ রচনা করলেন।বস্তুত,এই মায়াটিও ব্রহ্মই।কারণ এক ব্রহ্ম দ্বিতীয় নাস্তি।এভাবেই ব্রহ্ম আসলে নিজেই নিজের সঙ্গে উপগত হলেন।যাকে আমরা বলতে পারি সম্পর্ক স্থাপন করলেন।এটিই প্রথম সম্পর্ক সৃষ্টিতে।এবং নিরন্তর এত যে প্রাণের বৈচিত্র্য ও নানাবিধ সম্পর্ক বা সম্মেলন ঘটছে এ বিপুলা পৃথিবীতে তার সমস্তই ওই ব্রহ্মের স্বরূপ ও মায়া।অদ্বৈতবাদ ব্রহ্মকে এক ও অনেকের একমাত্র কারণ বলে মনে করে।পরমাত্মার থেকে সাময়িক দূরে চলে যাওয়াই জন্মের কারণ;মিলনে তার মোক্ষ।এই মিলন ও বিচ্ছেদের সম্পর্কই ফুটে উঠে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের লীলায়।

         খৃষ্টান বা ইসলাম ধর্মে আদম ও ইভকে আদি মানব ও মানবী বলে মনে করা হয়।এবং তাঁদের মিলনে এ জগত রচিত।আদম ও ইভের ধারণাটির সঙ্গে পুরুষ ও প্রকৃতির ধারণাটি অনেকটাই মিলে যায়।পুরুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কে সৃষ্টি রস,আনন্দ ও প্রাণের।এ যেন সেই সম্পর্কের স্বর্গীয় আপেল ভক্ষণের কারণ ও ফলাফল।

        পুরাণ বা অধ্যাত্ম ছেড়ে যদি বিজ্ঞানের দিকে যাই,তাহলে কিন্তু এই অদ্বৈতবাদটির  সমর্থন পাই।এ মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু একে অপরের সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িত।এবং পোজেটিভ ও নেগেটিভ তড়িতের মিলন ও বিচ্ছেদে নানা রূপে,নানা গুণে প্রতিভাত।পদার্থবিদ্যা যেমন শক্তির নিত্যতায় বিশ্বাস করে,অধ্যাত্মবিদ্যাও মনে করে প্রাণের বিনাশ নেই রূপান্তর আছে কেবল।

         প্রাণের এই অবিনাশী ধর্মটি কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রেও খাটে।সম্পর্ক ছিল না,শুরু হোল–এই ভাবনাটি আপাত সত্য,এবং ভুল।তেমনি সম্পর্কের মৃত্যু হোল এই ধারণাটিও ভ্রষ্ট।আপাত দৃষ্টিতে দুটি প্রাণি,পশু,পাখি বা মানুষ যাদের জীবনে কখনও দেখা হয় নি,কথা হয় নি,আমরা মনে করি তারা পরস্পর সম্পর্কহীন।কিন্তু তা ঠিক নয়,তারাও বিভিন্ন ভাবে সম্পর্ক যুক্ত।জন্ম যেমন দুঃখের কারণ,তেমনি সম্পর্কেরও কারণ। সম্পর্কের একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু আছে।এবং তার চারপাশে অসংখ্য ছোট-বড় বৃত্ত।একটি প্রাণীর সঙ্গে একটি প্রাণী,একটি জড় বস্তুর সঙ্গে আরেকটি জড়বস্তু,একটি প্রাণীর সঙ্গে একটি জড়বস্তু কোন না ভাবে এই ছোট-বড় বৃত্তগুলির নিরিখে সম্পর্ক যুক্ত।কেন্দ্রীয় বিন্দুটির যত কাছে বৃত্তগুলি আসতে থাকে সম্পর্কটির নাম-রূপ স্পষ্টতর হয়।দূরে থাকলে বা চলে গেলে এই পরিচয় অস্পষ্ট হয়।আর এই বৃত্তগুলি কেন্দ্রটির কাছে ও দূরে আসা-যাওয়া করতেই থাকে।ছোট ও বড় হয়ে।কিন্তু কখনোই একেবারে মুছে যায় না।

       ফ্রয়েড সমস্ত সম্পর্কের মধ্যেই যৌনতাকেই কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন।মা যে তার শিশুকে স্তন্য পান করান পরম আনন্দে।সাধারণ চোখে আমরা তো তার মধ্যে অপত্য স্নেহটিই দেখি।ফ্রয়েডের কাছে এই স্তন্যপান করার আনন্দটিও আসলে যৌনতৃপ্তি।একটি শিশুরও মায়ের শরীর ও মনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এই যৌনতার দ্বারাই।ব্যতিক্রম থাকলেও আমরা বেশিরভাগ সময় কি দেখি না বয়ঃসন্ধি কালে পুত্র মায়ের প্রতি,মেয়ে বাবার প্রতি অধিক আন্তরিকতা অনুভব করে! এটি কি ফ্রয়েড বর্ণিত যৌনাচরণকে মনে করিয়ে দেয় না? একটা কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই,প্রাণীজ সম্বন্ধে যৌনতার ভূমিকাটি অসীম।

         প্রেম।আমি নারী ও পুরুষের প্রেমকেই এখানে উল্লেখ করছি।এটি একটি আদি ও অকৃত্রিম সম্পর্ক।যুগে যুগে কত কত কবিতা,গল্প,উপন্যাস,নাটক ও গান লেখা হয়েছে এ সম্পর্কটিকে নিয়ে।কত আদর্শের,কত মহানুভবতার কাহিনি আছে প্রেমের।প্রেমের প্লেটোনিক ধারণা নিয়েই কি কম লেখালেখি হয়েছে! প্লেটোনিক অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন।এখানে দেহের তেমন গুরুত্বই নেই।কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সাহিত্যে এই প্লেটোনিক প্রেম তেমন গুরুত্বই পেল না।সেখানে পরিষ্কার বলা হলো,শরীর ছাড়া প্রেম অচল।আধুনিক কবি দ্বিধাহীন বললেন,আমি তারে ভালোবাসি রক্ত,মাংস,অস্থি,মজ্জা সহ।সে যাই হোক সম্পর্কের বন্ধনে দেহ কিম্বা আত্মার বাঁধন নিয়ে শেষ সত্য উচ্চারণ করা তত সহজ নয়,বোধকরি অসম্ভব।কারণ এ এত জটিল একটি বিষয়,যার ভিতরে প্রবেশ করলে সকলকেই অভিমন্যু হয়ে যেতে হয়।

       অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে,জড় বস্তুর চেয়ে মানবীয় সম্পর্ক অনেক বেশি জটিল।জটিল বলেই উন্নত।পশু-পাখিদের সম্পর্ক সাধারণত জৈবিক প্রবৃত্তিটিই সম্পর্কের নির্ধারক।জড়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ভৌত ধর্ম।মানুষের ক্ষেত্রে সম্পর্ক বহুমুখী,দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং অনির্দিষ্ট।একজন মানুষ পারিবারিক,সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক সম্পর্কের আলাদা আলাদা বৃত্তে আরেকজন মানুষের সঙ্গে  সম্পর্কযুক্ত।এই সব সম্পর্কের চালিকা শক্তি হিসেবে “স্বার্থ” এর ধারণাটি এসে যাবেই।বাবা-মা সন্তান পালন করে,তার মধ্যেও স্বার্থ আছে যেমন,তেমনি একজন ছেলে একটি মেয়ের,একটি মেয়ে একটি মেয়ের প্রেমও পড়ে স্বার্থেরই কারণে।আমাদের চারপাশে যে আত্মীয় বা কুটুম তাদের সাথেও আমাদের স্বার্থেরই সম্পর্ক।দাতা ও গ্রহীতার,ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কটিও এ থেকে মুক্ত নয়।  পদার্থের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই “স্বার্থ”টি বিদ্যমান–মানবিক ক্ষেত্রেও।স্বার্থ শূন্য কোন সম্পর্ক হতে পারে না–না মানবিক,না ভৌত,না জৈবিক।প্রসঙ্গত ,ফ্রয়েড “স্বার্থ” বলতে যৌনতার স্বার্থটিকেই উল্লেখ করেছেন।

        মহাভারতকে পঞ্চমবেদ বলা হয়।মানব সম্পর্কের বিচিত্রগামীতা এ মহাকাব্যে যত বেশি প্রতিভাত তা বোধহয় অন্য কোন কাব্যে নয়।কুরু ও পাণ্ডব– আদতে একটি পরিবারের সম্পর্ক এখানে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের অগণন টানাপোড়েন হয়ে উঠেছে ।কাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ।একজন ধুরন্ধর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব।নানা সময়ে ,নানা পরিস্থিতিতে মানব সম্পর্কের বদল ও তার কর্তব্যের ভাষ্যপাঠ করেছেন তিনি একজন বিশেষজ্ঞের মতোই।আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় এত হাজার বছর আগে রচিত এ কাব্যের ভিতরে কি প্রচন্ড ফ্লেক্সিবিলিটি এক একটি চরিত্রে! একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে অন্য পুরুষের বিছানায় অবলীলায় যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন,শ্রেষ্ঠ সন্তান উৎপাদনের জন্য।এখানে স্বামীত্বটির সঙ্গে যৌনতা অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠছে না।যৌনতা শুধুই কখনও আনন্দ,কখনও সন্তান উৎপাদনের কারণ।অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌনতা নিছক একটি মুক্ত সম্পর্ক–এর সঙ্গে জোরপূর্বক বিবাহ,দাম্পত্যের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় নি।যা আমাদের এত আধুনিক সমাজেও দুর্লভ।মহাভারতে,আরেকটি জিনিস খুব দেখি,একাধিক চরিত্রের একাধিক নাম।একাধিক ভীম,একাধিক পরীক্ষিৎ।এমনটা সাধারণত খুব বেশি ঘটে কি?আধুনিক নাটকে একটি চরিত্রের বহু শেড বোঝানোর জন্য কোথাও কোথাও এমনটি করা হয়।এই যে একজন মানুষ আলাদা নামে,এর মধ্যে একের মধ্যে বহুর সত্ত্বাটিকে বোঝানোর চেষ্টা–কি আধুনিক নাটকে,কি মহাভারতে।

          একের মধ্যে বহুর অবস্থানের এই সত্যটি,আমাদের একটি সম্পর্কের ভিতরেও বহুমুখী করে তোলে।কোন সম্পর্ককেই তাই একটি নির্দিষ্ট নামে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব।একটি পিতা-কণ্যার সম্পর্কে শুধুই অপত্য ধর্মটিই বজায় থাকবে এটি আরোপিত সত্য–প্রকৃত নয়।সেখানেও কিছু যৌনতা,কিছু বন্ধুতা,কিছু স্নেহ মিলেমিশে থাকবেই।এখানেও ভৌতের ধর্মটি প্রাসঙ্গিক।একটি অণুর ভিতরে পদার্থের সমস্ত গুণাবলী বিদ্যমান থাকবেই।মূলে তো সেই পুরুষ ও প্রকৃতি।তার এত রূপ! এত সম্পর্ক! আর তাই প্রত্যেকটি সম্পর্কের ভিতরেই মূলের সবগুণই প্রকট ও প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকবেই।এক কথায়,সম্পর্কের কোন নির্দিষ্ট নাম-রূপ হয় না।মহাভারত তা আমাদের দেখিয়েছেন।

      কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় অর্জুনকে কৃষ্ণ যে উপদেশ দিয়েছেন,যা শ্রীমদ্ভাগবত গীতা হিসেবে বিখ্যাত তাতেও পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পর্কের পরিবর্তনশীলতাটি দারুণভাবে বর্ণিত।এই মহাগ্রন্থে নায়কের চিন্তায় ব্যক্তির পারিবারিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক  সম্পর্কের ভিন্ন দৃষ্টিকোণটিও দারুণ ভাবে ব্যঞ্জিত।

       উপনিষদ দিয়ে নিবন্ধটি শুরু হয়েছিল,উপনিষদ দিয়েই শেষ হোক।ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা।ব্রহ্ম থেকেই সকলের উৎপত্তি।প্রতিটি প্রাণী,পশু,পাখি ও মানুষ।তাই সকলের ভিতরেই এক ও আদিম ধর্ম জাগরিত।তা হল একের প্রতি আরেকের আকর্ষণ।মহাভারতের নায়কের নামও তাই কৃষ্ণ–যে আকৃষ্ট করে।এই আকর্ষণ বিভিন্ন বস্তু ও প্রাণীর মধ্যে আলাদা কৌণিক অবস্থানে ক্রিয়াশীল।আর তাই এত রঙ,এত রূপ,এত রসের বৈচিত্র্য! এই অবস্থানটি পরিবর্তনশীল বলেই বস্তু ও প্রাণীর সম্পর্কের এত রঙ বদল,এত রূপ বদল,এত রসবৈচিত্র্য।এত নাম।এত পরিচয়।এক থেকে বহু।বহু থেকে একের সম্পর্কে।

সমাপ্ত
শচীন দাশ – “ উত্তর বসন্ত ”
বিপ্লব মাজী – “ সম্পর্কের বীজগণিত ”
Close My Cart
Close Wishlist

Close
Navigation
Categories

Add address

India