নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় – “ অসীম ধন তো আছে ” ২

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় – “ অসীম ধন তো আছে ” ১

যে গোলমেলে ঘটনা থেকে কারও কারও মুখে হাসি ফুশকে ওঠা, বা পেছনে লাগার প্রসঙ্গ, সেটা কিন্তু তুচ্ছ হলেও সাঙ্ঘাতিক। ছোটবেলার দিকে একটু হাসিমুখে ফিরে দ্যাখো, ঘটনাটার মধ্যে তোমরা সব্বাই কিছু না কিছু কমন পেয়ে যাবে। শিক্ষক-না-থাকা ক্লাসে ব্যাপক কলরব হয়ে চলেছে। একটি ছেলে তার সঙ্গীকে একটু চেঁচিয়ে ডেকেছে, অ্যায় অসীইইম … ঠিক সেই মুহূর্তে বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলেন অসীমবাবু। ব্যস, বিগড়ে গেলেন তো গেলেনই! যতই বোঝানো হোক, ব্যাপারটা কাকতালীয়, সেই ক্লাসের অসীম বা যে তাকে ডেকেছে দুটোই ভাল ছাত্র—  স্যারকে তারা খেয়ালই করেনি—  অভিমানে উন্মাদ আর কিছুতেই সে সেকশানে ক্লাস নেবেন না। অনেক বোঝানোতে হয়ত কিছুদিন পর নরম হলেন একটু—  কিন্তু অমনভাবে যে বোঝাবে, ততটা সময় কার আছে?

উন্মাদকে নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ শুনলে, দেখলে, আজও আমার বুকের ভেতরটা কেমন হিম হয়ে যায়। আমি, ছাত্রজীবন পেরিয়ে এসেও, যেটুকু সময় পেয়েছি, অসীমবাবুর স্বাভাবিক সঙ্গী—  এই তো, কালই যেন আমার কাঁধ ধরে হাঁটলেন, এবড়োখেবড়ো বিধান সরণির ফুটপাথ ধরে দুজনে ঠিক পৌঁছে গেলাম গলির ভেতর ছোট্ট এক বাসায়, বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে, বইখাতা সামনে রেখে বসে আছে ঠিক আমারই মতন রোগা, ফর্সা একটা ছেলে, স্যারকে দেখেই যার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল! নিখুঁত উত্তর কলকত্তায়ী ঘরানায়, উঠোন পিচ্ছিল হয়ে আছে ছড়ছড়ানো কলের জলে, খোলা উনোনের ধোঁয়ায় কিছুক্ষণ সব সাদা, সাদা … ভেতর থেকে ছেলেটির মা বেরিয়ে এসে বললেন, এই তো, কাল সবে জ্বর ছাড়ল, আজ ভাত খাবে …

শিল্পীঃ শান্তনু গাইন

হ্যাঁ, আমাদের ছোটবেলায় জ্বরজারিতে ভাত না খাইয়ে আরও দুর্বল করে দেবার একটা প্রথা ছিল। অসীমবাবু কিন্তু প্রিয় ছাত্রদের বেলা ঠিক মনে রাখতেন, কে কতদিন আসছে না। কেন আসছে না, তা নিয়ে জেনুইন ভাবনায় থাকতেন। আবারও মনে পড়ে গেল ক্লাসরুমের কয়েকটি মুহূর্তের কথা, কী সূত্রে এল প্রসঙ্গটা, তা মনে নেই। যে মানুষ তোমার মধ্যে, তোমার আড়ালে রয়ে গেছে, তাকে খুঁজে বার করে আনাই তো একজন শিক্ষকের কাজ …

সেই মুহূর্তে, আমার কাঁধে অসীমবাবুর হাত, উজ্জ্বল আয়ত দুটি চোখে আশ্চর্য এক দীপ্তি। মনে করে, এই এখনও আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

দুর্গম, দুর্জ্ঞেয় যে মানুষ আপন অন্তরালে, তাকে, এই দেশকালে, আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতে কে-ই বা বলে আর? এই মানুষে সেই মানুষ—  কালকূটের নানান লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে এই কথা। এলোমেলো, দোহারা, দু-তিনদিনের দাড়িমুখ, গোল গোল উজ্জ্বল দু-টি চোখ, ধুতি ও খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা আমার স্যার অসীমবাবুর সঙ্গে এসব নিয়ে মাঝেমাঝে অনেক সহজ কথা হতো কিন্তু! আমার বাচনভঙ্গির উচ্চাবচ সমস্ত এলোমেলোমি ধরতে পারতেন চমৎকার—  এমন কি, কবিতার ভেতরে ইললজিক্যাল ব্যাপারটাও যে একরকম লজিক—  একথাও যেন তাঁকে বলতে শুনেছি। বিস্তৃত ছাত্রমহলে না, একান্তে আমার সঙ্গে। অসমবয়সি একটি সমৃদ্ধ আড্ডা মনে পড়ছে। তখন হেয়ার স্কুলের ছাত্র নই আর। অবেলায় কলেজ কেটে, হেঁটে হেঁটে কফি হাউস অবধি এসে, পছন্দসই সঙ্গী না মেলায়, হেয়ার স্কুলের পাছদুয়ার পেরিয়ে ইডেন হস্টেলের পথে বেরোব ভাবছি—  দেখি লম্বাচওড়া লাল দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় নর্দমার ধার-ঘেঁষা চাতালের ধাপে বসে। হাসিখুশি অসীমবাবু!

পাগল মানুষদের বিচিত্র বন্ধুবান্ধব থাকতেই পারে, কিন্তু কলুটোলা-জ্যাকেরিয়া ষ্ট্রীট ফলপট্টির ব্যবসায়ীর মতন চেহারা তো ঠিক নয় এই মানুষটির! চোখের উজ্জ্বলতার স্পন্দনে বাজছে। উনি সহকর্মী, এখন নাকি জেলায় কোন স্কুলে পড়াচ্ছে—  আগে এই স্কুলেই ছিলেন। বুঝেছি, যাকে বলে মৌলবী স্যার! কলকাতার বাংলা স্কুলে লব্ধ জ্ঞানটির প্রয়োগে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলেন। ঊর্দু এবং সংস্কৃত ভাষায় শব্দার্থ, ধ্বনি তথা স্পন্দনে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকথা হচ্ছিল। অসীমবাবু ইংরেজিতে রেগুলার হিসেবে, বাংলা ও সংস্কৃতে প্রাইভেট এম.এ—  ঊর্দু শেখারও যে ইচ্ছে তাঁর ছিল, সে কথা বলেছেন অনেকবার। মূলত আমি বর্ধমানে বড় হয়েছি, ক্লাসমেট বা প্রতিবেশীসূত্রে অনেক ইসলামি নামের অর্থ যে জানি, কথায় কথায় সে কথা ওঠায় মৌলবীস্যার বেশ অবাক, খুশি-খুশি ভাব।

ক্রমশ প্রকাশ্য...

অভিষেক রায় – “ অচিন পটুয়া ও ছবি মেলা ”
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় – “ অসীম ধন তো আছে ” ৩
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India