‘ দ্যা টেলিগ্রাফ-এর সাক্ষাৎকারে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ’ ভাষান্তর – বিজয় দাস

ABHIJITKBঅর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জী এবং এস্থার ডাফলো তাঁদের কাজ “experimental approach to alleviating global poverty”-এর জন্য এই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত হন। দ্যা টেলিগ্রাফ ও অভিজিৎ ব্যানার্জী’র কথোপকথনে উঠে এসেছে কলকাতা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে তিনি পড়াশুনা করেছেন এবং কীভাবে তার কাজে বা একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে গড়ে উঠতে প্রভাবিত করেছে।

টেলিগ্রাফঃ নিজের চেয়ে বেশি কিছু জানেন এমন ব্যক্তির সাথে যুদ্ধে প্রবেশ করা সর্বদা ভুল।

অভিজিৎঃ কিন্তু এই যুক্তি সমগ্র পৃথিবীতে ব্যাপ্ত নয়, আমি বলছি…

বলুন, প্রফেসর ব্যানার্জী…

অভিজিৎঃ আমাকে প্রফেসর ব্যানার্জী বলবেন না। তিনি আমার বাবা। আমাকে অভিজিৎ বলুন…

আমি সাধারণত ওনাকে দীপকবাবু বলেই ডাকতাম, কিন্তু বাকিদের কাছে মূলত ডি.বি বলেই পরিচিত ছিলেন। এখনও পর্যন্ত নয় জন ভারতীয় নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। যদি আপনি একটি জনসংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা (Demographic Study) করেন তবে দেখবেন, বাংলার থেকে চারজন, চেন্নাই থেকে তিনজন। এবং রয়েছেন হর গোবিন্দ খোরানা (যিনি মেডিসিনের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন) আর কৈলাস সত্যার্থী (শান্তির জন্য) তাহলে কলকাতা আর চেন্নাই মিলেই মোটামুটি আশি শতাংশ।

অভিজিৎঃ আমার মনে হয় এটা পুরোপুরি দুটো আলাদা গল্প। ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন কলকাতা ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৌদ্ধক কেন্দ্র। আর তাই চেন্নাই থেকেও যে তিনজন নোবেল পেয়েছেন তারাও কলকাতা থেকেই পাস করেছেন। অন্ত্যত দুজন তো অবশ্যই।

ভেঙ্কী নয়

(শ্রী ভেঙ্কাটরমন রামাকৃষ্ণান, রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি, রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান)

অভিজিৎ ব্যানার্জী মাথা নাড়লেন

অভিজিৎঃ এই রকম কিছু সামঞ্জস্য তুলে ধরা সহজ, কিন্তু আমার মনে হয় একটা কারণ আছে অমর্ত্য আর রবীন্দ্রনাথের কলকাতা থেকে হওয়ার পিছনে। এটা কিছুটা আংশিক, কারণ একটা সময় কলকাতা ভারতের শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্র গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই এটা খুব দুঃখজনক হলেও বাস্তব। কলকাতা আর ভারতের শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্র নয়। কিন্তু আপনি অবশ্যই বলতে পারেন, পাঁচজন নোবেল পুরষ্কার প্রাপকের কিছু হলেও যোগাযোগ আছে কলকাতার সাথে।

আমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যদি বলি তবে ভাষাগত অনুষঙ্গ (linguistic affiliation) নিয়ে খুব বেশি করার কিছু নেই, কিন্তু সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে অনেক ভাবে ভাবার আছে, কেন বড়ো শহরগুলো এতো প্রয়োজনীয়। কারণ এই শহরগুলো শীর্ষ প্রতিভা বা মেধাকে আকর্ষণ করে, এবং এক প্রতিভাও অন্য প্রতিভার দ্বারা আকর্ষিত হয়। এইভাবে শীর্ষ প্রতিভাগুলি একজায়গায় এসে জড়ো হয়, তাঁরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে থাকেন আরও শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য। আমার মনে হয় এটাই একটা বড়ো শহরের মূল বৈশিষ্ঠ।

আর সেই একই কারণে একটা সময় প্রত্যেক শিল্পীরা প্যারিস যেতে চাইতেন, প্রত্যেক লেখকরাও চাইতেন নিউ ইয়র্ক যেতে। যদি আপনি নিউ ইয়র্কে গিয়ে সফল হন তবে একজন মহান লেখকে পরিণত হবেন। আমার মতে এটাই একটা বড়ো শহরের একমাত্র দাবী। এবং কলকাতা, হয়ত কোনও একটা সময়ে মহান শহর ছিল। আমিও আমার শুরুর দিকে, কিংবা আমার বাবাও এই একই সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন অমর্ত্য সেনের মতো।

তাই আমার মনে হয়না বাঙালিরা বিশেষ কিছু। এর কারণ বড়ো শহরগুলো বিশেষ।

সুতরাং আপনি বলছেন, আপনি এবং প্রফেসর সেন-এর পর আবার নোবেল পাওয়ার প্রতিযোগিতায় বাংলার সুযোগ অনেক কম।

অভিজিৎঃ ভারতের অন্যন্য শহরগুলোও আছে, কিন্তু আমার মনে হয় দিল্লির সুযোগ অনেক বেশি। কারণ এই সময়ে দিল্লি কলকাতার তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। আমার মতে ইন্টেলেকচুয়াল ভাইব্রান্সিই দিল্লিকে এই নতুন দিশা দিচ্ছে। কিন্তু এটা পুরোপুরি আমার নিজস্ব ধারণা। এছাড়াও আরও অনেক বিশিষ্ট-শিক্ষিত ব্যাক্তিরা আছেন যারা হয়ত অন্য রকম ভাবছেন তাদেরটাও অত্যন্ত মূল্যবান।

আমার বাবা আমাকে তার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়কার গল্প বলতেন। তিনি খুব ছোট শহর থেকে এসেছিলেন। তিনি হুগলীতে একটি স্কুলে পড়তেন। যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে গেলেন, সেখানে তের বছরের একটি ছেলে বৌধয়ন চট্টোপাধ্যায় যে মার্ক্স এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। আমার বাবাও তখন ওই তের কি সাড়ে তের বছরের যখন সেখানে ভর্তি হন। তো এই তের-চৌদ্দ বছরের ছাত্ররা যারা তাঁদের ইন্টারমিডিয়েট করতে এসেছেন। আর সেই তের বছরের আর এক ছাত্র বৌধয়ন চট্টোপাধ্যায় যিনি কবিতা আওড়াচ্ছেন বা মার্ক্স নিয়ে ভাবছেন এবং আরও অনেক কিছু। এইগুলোই অন্য ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করত। কারণ অন্যদের মনে আসত, ‘ও কত কিছু জানে’।

কলকাতা কেন এটা হারাচ্ছে?

অভিজিৎঃ এরজন্য অনেকটাই দায়ি অর্থনীতি। একসময় কলকাতা ভারতের সবথেকে ধনী শহর ছিল। আমার মনে হয়না এটা আকস্মিক। একটা সামাজিক স্তর নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত অনেক কিছুর প্রয়োজন, যা ছোটদের সঠিক শিক্ষা এবং শিক্ষার স্বাধীনতা দিতে সক্ষম হবে। তুমি যেখানে চাইবে সেখানে পড়াশুনো করতে পারবে। শুধুমাত্র IIT-র পরীক্ষা নিয়ে ভাবলেই হবে না। বিকল্প ভাবনা অনেক বেশি উদ্দেশ্যমূলক শিক্ষা পদ্ধতি। ফলে একজন উন্নতির সেই সূক্ষ্ম সরু পথেও লক্ষ্য স্থির করতে পারবে। কিন্তু এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস শুধুমাত্র ধনী সম্প্রদায় প্রদান করতে সমর্থ, তাঁরা তাদের বাচ্চাদের বলতে পারে, ‘দেখ, তুমি যেটা চাও সেটা কর, এবং কোনও সমস্যা হবে না কারণ তোমার সমস্ত সুরক্ষা বিদ্যমান’। ‘Look, do what you want, and you will be fine because you have all the protection.’

কিন্তু আপনার বাবা বা অমর্ত্য-এর সময়ে তো শিক্ষা অনেকটাই সমৃদ্ধ ছিল। কলকাতার শিক্ষা ব্যবস্থা নিচে নামতে শুরু করেছে এখানকার সামাজিক পরিবর্তনের সময় থেকে। রাজ্য সরকারের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো ম্লান হয়েও টিকে রয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর কাজ গুলো গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড না হলেও কিন্তু তা খুবই ভালো।

অভিজিৎঃ তবে অসাধারণ না, যেমন ছিল ১৯৫০-এর সময়ে। একটা সময় ছিল যখন পরিসংখ্যান তত্ত্ব বা ওই ধরণের গণিত বিষয়ক কাজের মধ্যে পৃথিবীর প্রধান চারটি প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল ISI । Kolmogorov (রাশিয়ান গণিতজ্ঞ) এখানে এসেছিলেন এবং এখানকার লোকেদের সাথে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাজ করেছিলেন। এটা পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুর মতো ছিল। ISI একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা সমগ্র বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমার মনে হয় না আমরা আর সেই অবস্থায় আছি। যদিও আমি এই বিষয়ে খুব কমই জানি।

এখনকার সময়ে সমস্ত প্রতিভা আমেরিকার দিকে ছুটছে, MIT কিংবা Caltech। কিন্তু ১৯৫০ বা ওই সময়ে ভারতীয় পদ্ধতি অনেক মানুষকে আকর্ষণ করেছে। এরা প্রত্যেকেই তখন ISI-তে এসেছিল।

অভিজিৎঃ অবশ্যই।

জে.বি.এস হ্যালডেন (বাওকেমিস্ট ও মার্ক্সিস্ট, যিনি লন্ডন ত্যাগ করেন এবং বিট্রিশ নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন কলকাতার ISI-এ কাজ করার জন্য) এবং এই রকম আরও অনেকে। পরিকল্পনার অভাবে এই ভিড় ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি আগের মতোই ভালো আছে। না, কিন্তু তবুও খুবই ভালো।

অভিজিৎঃ আমিও তাই মনে করি, এটা খুব ভালো। আমার মনে হয় আপনি একদম ঠিক কথাই বলেছেন যে, রাজ্য সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় ব্যর্থ। কিন্তু যদি আপনি এই প্রতিষ্ঠান গুলোকে দেখেন… উদাহরণ স্বরূপ, আমার মনে হয়, বহু লোক যারা বেসরকারি কলেজগুলোতে গেছেন। বঙ্গভাষী বা অন্যান্য। যদি আপনি ভেবে দেখেন, অনেক মহান সাহিত্যিক ব্যাক্তিত্ত্ব যারা কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে যাননি। এর গড় কিন্তু অনেক। এটা শুধুমাত্র সরকারি সেক্টরেই নয়। সরকারি সেক্টরের বাইরেও।

সুতরাং, রাজ্য সরকারও অনেক বাজে কাজ করেছে। কমিউনিস্ট গভর্নমেন্ট শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যা করেছে তা কিছু বলার নেই। আমার বাবাও বরাবর একই কারণে হতাশ হয়েছেন। যেখানে সেখানে যখন ইচ্ছে বদল করে দিয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনও আর্থিক সহায়তা করেনি। ইউনিভার্সিটিগুলোতে অযোগ্য উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি কলেজ গুলোও অনেক ভালো প্রতিভা সামনে নিয়ে এসেছে।

ভাবুন একবার ৩০, ৪০ আর ৫০ দশকের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্ফোরণ। তাদের কতজন প্রেসিডেন্সিতে গেছিলেন? তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বঙ্গভাষী, সিটি কলেজ বা অন্য জায়গার। তাদের কিছু স্কটিশ চার্চ-এরও ছিলেন।

হ্যাঁ, এটা ঠিক। এই মাধ্যমগুলো অনেক উচ্চমানের ছিল। কিন্তু শিক্ষকদের অবস্থা, তাদের ডিএ এবং সরকারি বেতন, কার্যত, বেসরকারি কলেজ গুলোও সরকারি কলেজে পরিণত হয়।

অভিজিৎঃ হয়ত। আবার হয়ত সরকার সমস্ত অযোগ্য লোকেদের নিয়োগ করেছে। তো আমার মনে হয় কিছু ক্ষেত্রে আপনি হয়ত ঠিক, কিছুটা সময়ের জন্য পে স্কেল ফ্ল্যাট হয়েছিল তবে তা কিছু সময়ের জন্যই , ১৯৮০ তেও তাই। এগুলো সাধারণত ভালো বেতনের চাকরি ছিল। আমার মনে হয়না আমরা এগুলো সমাধান করতে পারব। কিন্তু আমি মনে করি আসল সত্যিটা হল যে কলকাতা আর সেই মহান শহর নেই।

ভাবুন একটা সময় পুরো অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন সমস্ত ব্যক্তিত্বরা, থিয়েটারে উৎপল দত্ত, বাদল সরকার। এনাদের সকলের ভাবনা ছিল আমারা যেটা চাই সেটাই করব। কোনও জীবিকা নেই। তারা কেউ বড়লোক বা প্রভাবশালী ছিলেন না।

তাছাড়াও আমি যখন বড়ো হচ্ছি সেই সময়েও এই রকম কোনও বদ্ধমূল ধারণা ছিল না যে আমাকে IIT-তেই যেতে হবে। আমার মনে হয়েছিল কিছু অন্যরকম বা অন্যদের থেকে আলাদা কিছু চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু এখন লোকেরা সত্যি রীতিমতো ভয় পান যে তারা যদি দেশের বা বিশ্বের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে না পড়েন তবে তাদের বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠা হবার কোনও জায়গা নেই বা তারা বিশাল সাধারণের ভিড়ে আটকে পরবেন।

তবে দিল্লি কি সামঞ্জস্য ঠিক রাখছে?

অভিজিৎঃ আমার মতে দিল্লি অনেকাংশে ভালো ভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করছে। কারণ দিল্লিতে entrepreneurial class-এর লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। এনারা সকলেই উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের। আমি দিল্লির এইরকম কয়েকজনকে চিনি। তাদের কিছু জমিজমা বা সম্পত্তি ছিল সেগুলো বিক্রি করে দেন যাতে কিছুটা আরাম বা স্বাছন্দ্য পেতে পারেন।

আর, আপনি আপনার লেখা নতুন বই ‘Good Economics for Hard Times’-তে দিল্লিকে মাইগ্রেন্ট সিটি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আপনি নিজে যখন একদম প্রথম দিল্লিতে গেলেন, JNU-তে গেলেন, তখন আপনিও তো মাইগ্রেন্ট ছিলেন। দিল্লি না কলকাতা, কোন শহর আপনাকে বেশি প্রভাবিত করেছে? প্রেসিডেন্সি এবং JNU দুটি পুরোপুরি আলাদা ধরণের প্রতিষ্ঠান।

অভিজিৎঃ আমার মনে হয় এগুলো পুরোপুরি আলাদা। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি যে আমি একটা খুব অ্যাকাডেমিক পরিবারে জন্মে ছিলাম। আমি খুব ভালোভাবে পড়াশুনো ও অঙ্কের শিক্ষা পেয়েছিলাম। তাই আমার শুরুতে অনেক বেশি সুবিধাও হয়েছিলো। দিল্লি আমার সামনে পুরো ভারতকে প্রকাশ করেছিল। কিন্তু কলকাতায়, প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল এক ধরণের সমজাতিয়, উচ্চবর্ণের, উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বাঙালিরা। সেখানে উচ্চবিত্তের ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। এটাই বাঙলার খুব বড়ো সমস্যা।

যদি আপনি কমিউনিস্ট পার্টিতে দেখেন, সেখানে কতজন আছেন যারা উচ্চবর্ণের নয়? শুধুমাত্র হরেকৃষ্ণ কোনার— যদি আপনি জানেন তিনি কে (একজন রাজনীতিবিদ যিনি ভূমি সংস্কারের জন্য অনেক কাজ করেছিলেন)— কমিউনিস্ট পার্টিতে আর কোনও শীর্ষ নেতা নেই যিনি উচ্চবর্ণের নয়। এটা সত্যিই সমজাতিয়।

এটা খুব ব্রাহ্মণবাদী। এমন কি মমতা ব্যানার্জী একজণ ব্রাহ্মণ, এর আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উনিও ব্রাহ্মণ। শুধু মাত্র জ্যোতি বসু ছিলেন কায়স্থ। প্রফুল্ল সেনও।

অভিজিৎঃ সকলেই উচ্চবর্ণের। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রীই উচ্চবর্ণের। এবং এখানে এই সমজাতি ব্যাপারটা ভীষণ ভাবে বিদ্যমান। তাই আমার কাছে জাতি বা বর্ণটা কখনও বড় সমস্যা হিসেবে প্রকাশ পায়নি। সেই কারণেই আমার চারপাশের জগতে আমার মনে হয়েছিল জাতি বা বর্ণটা কোনও সমস্যাই না। আমারা সকলেই মূলত একই বর্ণ এবং একই উদ্দেশ্য ছিল। তেমনই প্রেসিডেন্সিতে। বা কেউ অন্য বর্ণের কাউকে বিয়ে করতে চাইলেও সেটা খুব একটা বড়ো ঘটনা ছিল না। কলকাতায় একজন ব্রাহ্মণ খুব সহজেই কোনও কায়স্থ বা অন্য কোনও বর্ণের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করতে পারেন। তাই আমার বর্ণ ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ কিছু ধারণা ছিল না।

কিন্তু যখন JNU-তে এলাম, এই জায়গাটা পুরো বর্ণ বৈচিত্রপূর্ণ। প্রত্যেকে জানত কার কোন বর্ণ বা কে কোন জাতি। বর্ণটা এখানে খুব বড়ো ব্যাপার। তুমি কি মৈথিলী ব্রাহ্মণ বা এস.সি বিহারী? ওখানে বর্ণ বৈষম্য ও বর্ণ বিরোধ প্রচণ্ড। এই জিনিসগুলো আমার কাছে নতুন ছিল, আমি কখনও এগুলো দেখিনি। আমার কাছে বাঙালি উচ্চবর্ণ হওয়া এবং বলা যে আমাদের ওখানে কোনও বর্ণ বিদ্রোহ নেই, খুব সহজ ছিল। এর পরেই যখন JNU-তে এলাম, দেখলাম এইরকম বহু সমস্যা যা আমারা কখনও বাঙলায় উপলব্ধি করিনি। এটা আমাকে অনেক শিক্ষিত করেছে।

আমি এই বিষয়ে লিখেওছি। JNU-র সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে আমার একটা বই প্রকাশিত হবে। সেখানে আমি বর্ণ সচেতনতা নিয়ে লিখেছি। এটা কোনও যুদ্ধ না, এটা একটা সচেতনতা।

তাই JNU আমার শিক্ষায় অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। অনেক বড়ো এবং একটা নির্দিষ্ট অংশ আমার শিক্ষার। আমি আমার কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত ভারতে থাকা সত্ত্বেও বর্ণ ব্যবস্থা নিয়ে কোনও ধারণা ছিলোনা। এটা একটা অস্বাভাবিক সুযোগ ছিল যা আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছিল।

সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা কি ছিল?

অভিজিৎঃ বর্ণ বৈষম্য ও দারিদ্র এটাই। JNU-তে এমন অনেক ছাত্র ছিলেন যারা খুব গরিব।

কলকাতায় নয়?

অভিজিৎঃ প্রেসিডেন্সিতে নয়। প্রেসিডেন্সিতে এমন অনেকে ছিলেন যাদের সাথে আমার ভাবনা বা ধারণার অনেক পার্থক্য ছিল। তারা অনেকে গরিবও ছিল। আমি এমন অনেকেই চিনি। আমারা একসাথে ক্যারাম খেলেছি কিন্তু আমরা কখনও পলিটিক্স, অর্থনীতি বা ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করিনি। কিন্তু তাদের মধ্যেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ তো অবশ্যই ছিল কিন্তু সেটা আমার থেকে আলাদা।

আর এইভাবে তাদের জীবন সম্পর্কেও জেনেছি যেটা আমার থেকে পুরো আলাদা ছিল। আর এটাই খুব আকর্ষণীয় ছিল।

ওল্ড বয়েজ’ নেটওয়ার্ক?

অভিজিৎঃ হ্যাঁ, আমি ওর মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু JNU-তে এসে এমন একটা জগতে এসে পৌঁছলাম যেখানে খুব কম লোক আমাকে পছন্দ করত। সেখানে বহু ছাত্র ছিল যারা নিম্ন বর্ণ থেকে এসেছিল। একজন উড়িষ্যা থেকে গরিব চাষির ছেলে ছিল, ও আমাদের ছাত্রদের মধ্যে সবথেকে ভালো ছিল। একজন ব্রাহ্মণ ছিল খুব গরিব, ওদের কোনও পয়সা ছিল না। এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা জগত।

আপনি কি খুব সচ্ছন্দে মিশেছিলেন?

অভিজিৎঃ জানি না। আমি অতটা ভাবিনা। কিন্তু আমরা মিশেছিলাম।

তাহলে আপনি বলছেন এই সমসত্ত্বটা(homogeneity) পশ্চিমবঙ্গের এই সমস্যার মূল কারণ?

অভিজিৎঃ এটা শুধু একটা অনুমান মাত্র। তবে এটা আমি বলিনি, আপনি বলছেন। কিন্তু কিছুটা হলেও ঠিক। একবার ভেবে দেখুন পশ্চিমবঙ্গের দলিত আন্দোলনের ব্যাপারে। এইরকম কোনও ঘটনা কি আপনি ভাবতে পারছেন? আমি মারাঠি দলিত আন্দোলনের ব্যাপারে জানি। আমার মা নির্মলা, মারাঠি ছিলেন। আমি মহারাষ্ট্রের দলিত আন্দোলনের ব্যাপারে জানি। বাঙলায় কি কোনও দলিত আন্দোলন হয়েছে? আমি ঠিক জানি না। শুনিও নি।

এই সকলে তো আমরাই?

অভিজিৎঃ হ্যাঁ। তবে তা আংশিক, কারণ এদের পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রের এতো বড়ো দলিত আন্দোলন। মহারাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে এটা আরও বেশি সংঘাতমূলক, কিন্তু এই আন্দোলন সংস্কৃতি লেনদেন পরিচালিত হওয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন করে কারণ হঠাৎ করে বর্ণ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়। এবং এর মধ্যে আপনার অবস্থান কোথায়, কোন পক্ষে আপনি আছেন সেটাও ভাবতে হবে। আর কার প্রতি আপনি সহানুভূতিশীল। আপনাকে নিজের অবস্থানটা ঠিক করতে হবে। সেই দিক দিয়ে আমি শুধু আপনার সাথে একমত।

এটা নিয়ে আরও যদি দেখি। টয়েনবি-এর ভাবনায়(ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি), এই দ্বন্দ্বই ইতিহাসের অগ্রগতিকে পরিচালনা করে। দ্বন্দ্বে চ্যালেঞ্জ বাড়ে আর চ্যালেঞ্জে প্রতিক্রিয়া বাড়ে।

অভিজিৎঃ মার্ক্সেরও এই একই বিশ্বাস ছিল। অনেকেই আছেন তাঁরা এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী, কিন্তু আমি নই। আমার মনে হয় আপনিই ঠিক। অনেকাংশে এই বৈষম্য থাকা সবসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে না, বাংলাতেও অনেক SC এবং OBC আছে। আমাদের আসলে বর্ণ সচেতনতা খুব একটা নেই।

যদি বাংলার বৈষ্ণবদের কথা ধরি। তারা মুলত নিম্ন বর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু সামাজিক কুসংস্কারগুলো কিন্তু এত সহজে বিলুপ্ত হয় নি। এটা ভারতের বাকি অংশগুলোতে কিন্তু সত্যি নয়, যেখানে বৈষ্ণবরাও মূল হিন্দু ধারার অংশ।

অভিজিৎঃ তামিলনাড়ুর মতো।

এরপর আপনি গেলেন হার্ভার্ডে। এটা কেমন ছিল?

অভিজিৎঃ ওটা অনেক বড়ো লাফ ছিল। JNU আমাকে কখনও আমার কাজের অভ্যাস তৈরিতে সাহায্য করেনি। এখানে আমি কখনই কঠোর পরিশ্রমের শিক্ষা পাই নি। গ্রেডের চাপ খুব বেশি ছিল বলে আমার মনে হয় না। এরপর আমি হার্ভার্ড আসলাম এবং এখানেই আমেরিকার কাজের অভ্যাসের সংস্পর্শে আসি। প্রথম দিকে আমি বিশেষ বুঝতে পারিনি যে আমি কতটা পিছিয়ে রয়েছি। আমার মধ্যে এমন একটা ধারণা ছিল যে আমি সব বুঝতে পারি। কিন্তু লোকেদের কঠোর পরিশ্রম, যা আমি প্রথম আমেরিকায় এসে শিখেছি। তাই এটা খুব আকর্ষণীয় ছিল।

তাহলে আমরা বলতে পারি বাংলায় আপনি অনেক সুবিধা ও একই মানসিকতার লোকেদের মাঝে ছিলেন। JNU-তে আপনি আসল ভারতের সন্ধান পেলেন এবং বর্ণ বৈচিত্র আপনাকে প্রভাবিত করল এবং সমৃদ্ধ করল। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের শিক্ষা আপনি পাননি, যা আপনাকে ইউনাইটেড স্টেট শিখিয়েছে?

অভিজিৎঃ অবশ্যই। আমি কঠোর পরিশ্রম করতে শিখেছি।

এবার আমরা আপনার নতুন বই ‘Good Economics for Hard Times’ নিয়ে একটু আলোচনা করি। আমরা ইমিগ্রেসন-এর অধ্যায়টা দেখি। তো এই অভিজ্ঞতা আপনার লেখাকে আরও বর্ণময় করে তুলেছে?

অভিজিৎঃ আমরা এমন কিছু মানুষের সাধারণ টিপিকাল বাঙালির উদাহরণ দেখিয়েছি যাদের আমি চিনতাম, যারা কখনই নিজেদের বাড়িতে খাবার থালা ধুতেন না, কিন্তু তারা রেস্টুরেন্ট দিয়ে তাদের কাজের শুরু করেছিলেন কিন্তু পরে তারা উদ্যোক্তাও হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আমেরিকা এমন একটা জায়গা যেখানে কঠোর পরিশ্রমই একমাত্র মূল্য। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা কমছে কারণ আমেরিকাতেও শ্রেণি কাঠামো গড়ে উঠছে। এই পরিবর্তন হয়েছে শেষ চল্লিশ বছরে। আমেরিকাও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

তাহলে বাংলার জন্য একমাত্র রাস্তা ব্যানার্জীর এই ভারসাম্যটি ব্যবহার করা, একটি জাতিয় জনসংখ্যার তালিকা তৈরি করা। তাহলে কিছু মানুষদের বের করে দিয়ে তার জায়গায় মাইগ্র্যান্টদের বদল করা। এতে কি কাজ হবে ?

অভিজিৎঃ এটা একদম ঠিক যে বাংলার মাইগ্র্যাসন প্রয়োজন। আপনি জানেন, সাধারণত সত্যিকারের প্রভিভা বেড়িয়েছে তামিলনাড়ু থেকে। বাংলায় যখন আমি বড়ো হচ্ছি, তখন তামিল ব্রাহ্মণে ভর্তি ছিল। দ্রাবিড় আন্দোলনের সময় তারা বেরিয়ে এসেছিল এবং দক্ষিণ কলকাতায় বসবাস শুরু করে। আমাদের ভাড়াটেও ছিল যারা তামিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখার্জি পরিবারের আধিপত্যের সময় অনেক সেরা তামিল প্রতিভারা কলকাতায় কাজ করেছেন। তাই, সি.ভি রমন এবং কৃষ্ণন এবং চন্দ্রা (Subrahmanyan Chandrasekhar) এনারা প্রত্যেকেই কিছু সময়ের জন্য হলেও কলকাতায় এসেছিলেন। চন্দ্রা ওনার বাওগ্রাফিতে এবং সি.ভি রমন-ও বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন যে সেই সময় খুব দৃঢ় তামিল বিরোধী মনোভাব ছিল। সি.ভি রমন চলে যেতে বাধ্যও হয়েছিলেন।

অভিজিৎঃ এটা হয়ত সত্যি। কিন্তু এটাও সত্যি যে তামিলনাড়ুর তুলনায় এটা অনেক ভালো জায়গা ছিল। তাই আমি যখন বড়ো হচ্ছি অনেক প্রতিভারা এখানে ছিল।

MIT-তে আমাদের কিছু প্রফেসর ছিলেন যারা কলকাতা থেকে ছিলেন।

তাদের মধ্যে একজন মারোয়াড়ী ছিলেন, আগারওয়াল। আর একজন ছিলেন কলকাতার তামিল। ইংলিশেও একজন তামিল ছিলেন, শঙ্কর রমন। এনারা প্রত্যেকেই দক্ষিণ কলকাতা থেকে ছিলেন।

প্রফেসর আগারওয়াল, এনি কি পড়াতেন?

অভিজিৎঃ তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অরগানাইজেসন পড়াতেন। কলকাতা এমন একটা শহর ছিল যেখানে বিভিন্ন জায়গার লোকেরা থাকতেন। কিন্তু এখন তারা মুলত চলে যাচ্ছে। যখনই পরবর্তী প্রজন্ম সুযোগ পাচ্ছে তারা চলে যাচ্ছে। সুতরাং, আমরা আর প্রতিভাদের আকর্ষিত করতে পারছি না। আমি আপনার সাথে তাই একমত নই। আপনি জানেন, এই ভাবে লোকদের বের করে দেওয়া হচ্ছে।

আমি না। হয়ত বিজেপি।

অভিজিৎঃ আমি এসবের মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু যদি বাংলাকে বাঁচতে হয় তবে নতুন নতুন প্রতিভাদের আকর্ষণ করতে হবে। এটাই সমস্ত বড়ো বা মহান শহরগুলোর উদ্দেশ্য। তারা বেঁচে থাকে অন্যদের-অন্য প্রতিভাকে আকৃষ্ট করে।

মনে হয় যে, সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলোতে আপনার কাছে প্রশংসিত, অন্তত আপনার JNU-র সহপাঠী নির্মলা সীতারমন-এর এই বাজেটের আগে পর্যন্ত। পরে আপনি বলেছেন, এই ট্যাক্স কমিয়ে তারা রীতিমতো লুঠ করছে। এটা কি হঠাৎ করে নেওয়া সিদ্ধান্ত ছিল! কিন্তু তবুও এখনও আপনি ওই পলিসি গুলোকে অস্বীকার করছেন না। আসলে আপনি ওই পলিসি গুলো অনুমোদন করছেন। কিন্তু আপনি চাইছেন কর-অর্থায়িত করতে, পরিবর্তে তারা এখন ঘাটতি অর্থায়নের মাধ্যমে আংশিকভাবে এটি অর্থায়ন করছে। সুতরাং, আপনার অস্বীকৃতির প্রকৃতি কেবলমাত্র প্রক্রিয়াভিত্তিক। কিন্তু আপনি substance-টাকে এখনও সমর্থন করছেন।

অভিজিৎঃ এগুলো আদালা। আমি অনেক জায়গাতেই বলেছি। একটা জিনিস যেটা আমি মনে করি, তাঁরা অর্থনীতির ক্ষয়-ক্ষতি ঘটিয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেকটা কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠেছে এবং যেটার জন্য আমাদের মূল্য দিতে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এমন জায়গায় বিনিয়োগ করতে বা থাকতে চান না যেখানে সমস্ত কিছু আটকে রাখা হয় এবং খুব অল্প সংখ্যক কিছু লেকেদের কাছ থেকে অনুমোদন পেতে অপেক্ষা করতে হয়।

সুতরাং, সরকারের এই প্রোগ্রাম বা নীতি গুলো নিয়ে আপনার কোনও অসুবিধা নেই?

অভিজিৎঃ আমার ক্ষেত্রে, এটাও একটা প্রোগ্রামের অংশ। যদি আপনি বলতে চান এই নীতিতে ট্যাক্স অনেক বাড়ছে এবং আরও উন্নতি হচ্ছে, আমি এটাকে সমর্থন করি, আমাকে সবসময় দেখতে হবে যদি আমি ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়িয়ে থাকি তবে কি আমরা উন্নতি আরও বেশি করতে পারব?

আমি এটাই বলেছিলাম যখন NYAY-কে সমর্থন করার জন্য সবাই আমাকে আক্রমণ করেছিল। আমার বক্তব্য এটা ছিল না যে NYAY খুব ভালো পরিকল্পিত কিন্তু ধারণাটি, আমাদের উচিত আক্রমণ করা কারণ ইট ইজ সপ্‌ টু দ্যা পুওর এবং আমাদের ধনীদের কখনই কর দেওয়া উচিত নয়। এর জন্য আমার কোনও সহানুভূতি নেই। এটা আমাদের বইয়ের একটা খুব বড়ো পয়েন্ট।

আপনি অন্য আরেকটা যুক্তি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন উচ্চ কর (High Taxation) ভালোও না আবার খারাপও না। মিলটন্‌ ফ্রায়েডম্যান, একটি নেতিবাচক কর ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছিলেন। ইউ.এস-এর তথাকথিত ডানপন্থী সরকারের, যেমন রিচার্ড নিক্সন্‌ এবং অন্যরা, একটি আইন প্রস্তাব করেন, যেখানে ফান্ড ট্র্যান্সফার করা যাবে। কোনও ন্যূনতম সাধারণ আয় থাকবে না।

অভিজিৎঃ ডান এবং বাম কেউই ৩৫ বা ৪০ বছর ধরে এই বিষয়ে একমত নয়। Eisenhower ও ১৯৮০-এর মধ্যে কোনও রকম মতানৈক্য ছিল না যে কর বেশি হওয়া উচিত এবং সমাজে তা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও উদার হওয়া উচিত। সবাই এক বিষয়ে একমত ছিল। কিন্তু Reagan, যিনি সব বদলে দিলেন।

তবে এটা কেন বিতর্কিত হয়েছিল?

অভিজিৎঃ এই গল্পটা আমরা আমাদের বইয়ে বলেছি। এর মূল কারণ উন্নতি বন্ধ হয়েগেছিল, এবং লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।

তো, মনমোহন সিং-এর সময়ে শেষের দিক থেকে উন্নতি বন্ধ হয়ে যায় এবং এটা অব্যাহত রয়েছে মোদী-১ এবং মোদী-২ সময়েও?

অভিজিৎঃ আমার মতে সত্যি হল, উন্নতির গতি খুব ধীর ছিল এবং এই জন্যই আমাদের কিছু করার প্রয়োজন। আমার নিশ্চিত মনে হয় যে উন্নতির গতি হ্রাসের জন্য অতি-কেন্দ্রীভবনের হয়ত কিছুটা করণীয় আছে।

বাস্তব জীবন অনেক জটিল। চার ধরণের মন্দার কথা বলা হয়েছে। বিমল জালান বলেছিলেন, এটা চক্রাকার— রাতের পর দিন আসার মতো চক্রাকার। ওমকার গোস্বামী-র দাবী এটা কাঠামোগত। বর্তমানের মন্ত্র হল পুরো পৃথিবীতে মন্দা চলছে, কিন্তু ইউ.এস বা ইউরোপ, ওখানে তো কোনও মন্দা নেই। চতুর্থ, মনমোহন সিং বলেছেন, এটা মানুষের তৈরি একটা মন্দা, ডিমনিটাইজেশন-এর প্রভাব।

অভিজিৎঃ আমি জানি না। আমি নিশ্চিত হতে পারছি না যে প্রমাণ একরকম বা অন্যরকম, নিষ্পত্তিযোগ্য অথবা এই সমস্যার মূল কারণ ডিমনিটাইজেশন না অন্য কিছু। আমি এখনও ঠিক জানিনা।

গীতা গোপীনাথ (হার্ভার্ড-এর অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বর্তমানে IMF-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ) ‘Quarterly Journal of Economics’-এ এই বিষয়ে লিখেছেন।

অভিজিৎঃ হ্যাঁ, আমি দেখেছি।

আপনি আপনার বইয়ে বলেছেন, ডিমনিটাইজেশন-এর পর তিরুপুর টেক্‌সটাইল হাবের বিক্রি ৪১ শতাংশ কমে গেছে?

অভিজিৎঃ আমি নিশ্চিত যে কিছু ঘটেছে। প্রশ্নটা হল যে এটা কি একটা আচমকা ধাক্কা ছিল কি না। আমি একমত নই। আমরা খুব ভালো ভাবে নিরীক্ষণ করেছিলাম। তাহলে প্রশ্ন হল যে, বিশেষত অর্থনীতিতে অন্যান্য সমস্যা গুলো তখন অনুপস্থিত (demonetisation was responsible)। আমি যে সম্পর্কে সত্যিই উদ্বিগ্ন যে, ‘the support prices pushed down and the terms of trade in agriculture.’ এটা সম্পূর্ণ আমার ভাবনা যে, এটা এই সমস্যার সবচেয়ে বড় অংশ। আমার মনে হয় না গীতা এই সমস্ত ব্যাখ্যা গুলো বলতে চাইছেন। তিনি দাবী করছেন কিছু একটা ঘটেছে। সেটা কতদিন, তা আমরা বলতে পারবো না। যদি অর্থনীতির চাহিদা না থাকে তবে কি এটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে?

কয়েকটা ঘটনা একই সাথে পরপর ঘটে গেছে। সাপোর্ট প্রাইসেস। কেন্দ্রীকরণ। এরপর আসলো ডিমনিটাইজেশন।

অভিজিৎঃ অর্থনীতিবিদরা খুব কমই একমত হবেন।

কিন্তু তারা তো ভগবান হতে চান। Skidelsky (Oxford Historian), তাঁর বহুল প্রশংসিত আত্মজীবনীর শিরোনাম করেছেন ‘The Economist as Savior.’ চিকাগোর সরকারি নীতি গ্রহণে শোক প্রকাশ করে একজন আমেরিকান সম্পাদক একটি বই লিখেছিলেন (বিশেষভাবে ফ্রেডম্যানকে উল্লেখ করছি)।

অভিজিৎঃ Binyamin?

(Binyamin Apelbaum নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদক, যিনি ‘The Economists Hour’ বইটি লেখেন।)

হ্যাঁ।

অভিজিৎঃ অর্থনীতি সবচেয়ে কার্যকর শৃঙ্খলা, এই সত্যটি রক্ষার জন্য আমি সম্পূর্ণ আমার বইটি লিখেছিলাম। শুধুমাত্র একটা জিনিস করার চেষ্টাই আমরা করেছি, যেটা হয়ত অন্যান্য অর্থনীতিবিদদের থেকে আলাদা। আমরা কারণ প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছি। আমরা চাই লোকেরা বুঝতে চেষ্টা করুক তারাও অংশগ্রহণ করুক, কেন এই যুক্তিগুলো ঠিক, এবং এতে তাদের বলার ও বোঝার স্বাধীনতা দেবে, ‘Look but this evidence is different. We are trying to make the case.’

সুতরাং আপনিও একজন শিক্ষক হয়ে উঠছেন।

অভিজিৎঃ আমরা সকলেই শিক্ষক।

আপনার বাবা মতো। (‘Your Father’s Son.’)

অভিজিৎঃ অবশ্যই। আমি ১০০ শতাংশ একজন শিক্ষক, আমি চাই সকলে বুঝুক, তারা অংশগ্রহণ করুণ এই সমস্ত বিষয়ক আলোচনায়, সত্যের উচ্চারণের জন্য এটি একটি বদ্ধ মেশিন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি না। এমন জায়গা হওয়া উচিত যেখানে সমস্ত সংশয় সম্বন্ধে জানা ও বোঝা যাবে। এমন একটা কাঠামো যেখানে সংশয়-সন্দেহগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

আমরা যতক্ষণ না জনসাধারণের স্থান থেকে সরে আসছি ততক্ষণ অর্থনীতি মতবিরোধের পক্ষে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমরা আমাদের ব্যাক্তিগত জায়গায়, আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়, আবার ভালো আলোচনাও হয়। কিন্তু জনসমক্ষে আমরা হয়ত ভবিষ্যৎবাণী করি। আমার বইটা এই সমস্ত ভবিষ্যৎবাণীর প্রতিরোধ, ইতিহাসের সমস্ত ভবিষ্যৎবাণীর, এগুলো মানুষকে ভয় পাওয়ায়। কারণ তারা সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেন না। তাই আমারা আশাকরি ভীষণভাবে চেষ্টা করেছি সাধারণ ভাষায় লিখতে। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি সাধারণ স্থানীয় ভাষায় লিখতে।

হ্যাঁ, বইটি খুব সহজবোধ্য।

অভিজিৎঃ আমরা এটাই চেষ্টা করেছিলাম। জানিনা আমরা ঠিক না ভুল, তবে আমাদের প্রথম চেষ্টাই ছিল সহজ রাখার।

আপনি কীভাবে লেখেন? আলাদাভাবে লিখে তারপর সেগুলো একসাথে করেন?

অভিজিৎঃ সাধারণত, আমার এবং এস্থারের মধ্যে দুই-তিন দিন ধরে আলোচনা হয় এবং তারপর সে অনেক তথ্য যোগার করে আর আমার কাজ সেগুলো বোঝা এবং এগুলোকে একটা আখ্যানে পরিণত করা। প্রথমে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ভাবনা চিন্তা করে অনেক গুলো বড়ো বড়ো খসড়া তৈরি করি তারপর সেগুলোকে একটা ছোট আখ্যানে পরিণত করি। সুতরাং আমার কাজ হচ্ছে ওইগুলো দিয়ে আখ্যান তৈরি করা। এখানে (এই বইটাতে) আমি ওই রকম ভাবে দুটির মতো অধ্যায় লিখেছি।

বাড়িতে, আপনারা দু’জন কি কাজ বিষয়ক কথা বলেন? বা ডাইনিং টেবিল আলোচনায়?

অভিজিৎঃ কখনও আমার কাজ নিয়েও কথা বলি। খাবার টেবিলে, বাচ্চারা থাকে, সাধারণত কোনও কথাই হয় না, জিরো— যদিনা কোনও গেস্ট থাকে।

যখন আপনি প্রথম নোবেল কমিটি থেকে জানতে পেলেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

অভিজিৎঃ খুব ভালো লেগেছিল। তারপর আমি ভাবলামঃ ‘এটা কি প্রতারণা হতে পারে?’ কিন্তু একটা সময়ে আমি নিশ্চিত হলাম। তখন ভোর ৪.৪৫ বাজে, আমি আবার ঘুমোতে চলে গেলাম। এটাই সত্যি।

সেলিব্রেট করলেন কীভাবে?

অভিজিৎঃ আমি রাতের খাবার বানালাম, মাশরুম, গ্রিন পিজ্‌ আর চিজ দিয়ে স্টাফ করা অমলেট।

হলুদ আর সাদা আলাদা আলাদা করে?

অভিজিৎঃ না! একসাথে।

সাথে জলও ছিল।

দুধ?

অভিজিৎঃ না, আমি দুধ নেই নি, এমনিতেই অনেকটা রিচ হয়ে গেছিল। আমার মতে এটা অল্প আঁচে করা উচিত, তাতে নরম হয়। এবং খুব ভালো হয়। আমি এই কাজগুলোতে খুবই স্বতঃস্ফূর্ত— আমি আমার জীবনে অনেক অমলেট বানিয়েছি এবং বেশিরভাগই সঠিকভাবে।

ধন্যবাদ
বিজয় দাস – ‘ এডগার অ্যালান পো : এক অনন্য কবিতা জগৎ ’
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India