শুভ্র মৈত্র – ‘ কিছুই বুঝা যেইছে না ’

বিভাগঃ গল্প

আব্বার কাছে তেমন বসি না। সে তো কোন পহতবেলা কোদাল ঝুড়ি নিয়ে টাউনে চলে যায়। সাঁঝের টাইমে যখন বাড়ি ঢুকে, তখনও আমি কাছে ভিড়ি না। ডর লাগে। না, আমাকে মারে না, মাকে মারে। আবার সোহাগও করে মায়ের সাথে। আমি দেখেছি। তখন আমি দাদির কাছে থাকি। মা আর দাদিই বন্ধু আমার। আব্বা সকালে বেরিয়ে গেলেই আমার মজা লাগে। সতীশ মাষ্টারের ইস্কুল তো সেই দুপুরবেলা। আমি তার আগেই বেরিয়ে যাই। আলতাফ, তারিকুল, নূর, সাহেব সবাই। কোথায় যাই কিছু ঠিক থাকে না। ঘুরি এদিক সেদিক। বাগানের ভিতর। ঝাল খাই গাছে। বাগানের জোগানদার গাল দেয়। মারতেও আসে। তবু লুকিয়ে ডালে চাপি। উপর থেকে লাফাই। আমার পকেটে গুলি থাকে। ইস্কুলেও নিয়ে যাই। আলতাফ, নূর—সবাই খেলি। সেদিন গুনলাম, এখন বাষট্টিটা। নূর এর অবশ্য একশোর উপর।আব্বা দেয় না, মায়ের কাছেই পয়সা নিই। দাদিও দেয়। যখন থাকে।

নূর যদি বাড়ি থেকে আচার চুরি করে আনে, তবে খাই। মারপিটও করি। তবে লদির দিকে যাই না। ঐ তো লদি, বাড়ি থেকেই দেখা যায়। কিন্তু দাদি-মা—-সবাই সবাই বলেছে না যেতে। তবু গেছি। আলতাফ তো পানিতে নামে। ও তো হেলতেও পারে। আমি পারি না। তবু পানিতে আমার ডর লাগে না, আব্বাকে লাগে। মা বলেছে, পানিতে গেলে আব্বাকে বলে দিবে।

সেদিন মায়ের উপর খুব রেগে গেছিল আব্বা, চুলের মুঠি ধরে মারছিল। দাদিও থামাতে পারছে না। আমি খুব ডর খেয়ে গেছিলাম। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছিলাম। সাদিক চাচার টাটির ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম আমাদের ঘরের দিকে। আব্বা হঠাৎ বেরিয়ে এলো, আমার সবটি গুলি ন্যাকরা থেকে বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে, অন্ধকারে। আমাকে দেখতে পায় নি। দেখলে হয়তো আমাকেও ছুঁড়ে ফেলত।

তারপর আব্বা যখন শান্ত হল, ঘরে ঢুকে আমি দাদির কাছে ঘুসে গেলাম। মাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে না একটু আগেই মার খেয়েছে। হেসে হেসে ভাতের সাথে লাল লাল মাছও দিয়েছিল। না, আব্বা ভাত ফেলে দেয় নি রাগ করে। এই মাছটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি চিনি, রিঠা মাছ। আলতাফ লদির পানি তে নেমে পাথরের খাঁজ থেকে একদিন ধরে এনেছিল, দেখেছি। বাড়ি নিয়ে গেছিল ও।

আর পহতবেলায় আব্বা বেরনোর পরেই আমি ছুট্টে গেছিলাম বাগানে। ঢুনতে লাগলাম গুলি। অনেকগুলি পেলামও। সবটি পাইনি। তারপর থেকে বাঁশের ভিতর লুকিয়ে রাখতাম। দাদিই দিয়েছিল বুদ্ধিটা।

এই মেঘের দিনগুলান ভালো লাগে না হামাকে। মুরগি দুটা যেমন বেরায় না ঢোপ থেকে, আমিও পারি না। বাগানে মাটি ভিজে থাকে। খেলা হয় না। সব দিকে শুধু পানি আর পানি। লদিটা শুধু বড় হয়ে ঢুকে যায় গ্রামের ভিতর। বাগানের শেষে যেখানে নানার গোর আছে, গ্রামের সবারই আছে, দাদি যেখানে যায় মাঝে মাঝে, লদিটা এখন তার কয়েক হাতের মধ্যেই। মা আমাকে লদিতে যেতে দেয় না, আর লদি এখন নিজেই যে চলে আসছে!

আলতাফ, রিয়াজ দের খুব মজা। সারাদিন পানিতে হেলছে। আমিও যাই। সবাই যায়। কিন্তু গুলি না খেললে আমার মজা হয় না। পকেটেই থেকে যায় গুলি। খেলা আর হয় না। মাটিতে পানি যে। আর হঠাত করে যখন বৃষ্টি আসে, ছুটতে হয়।

আব্বা সেদিন দাদিকে বলছিল, টাউনে নাকি কামও কমে গেছে। পানি কমলে দিল্লি যাবে মোমিন চাচার সাথে। কয়েকদিন তো গেলই না আব্বা। বাড়িতে শুধু খিচুড়ি। ইস্কুলেও তো খিচুড়ি দেয়। ভাললাগে না।

মেঘ যেদিন থাকে না, মায়ের কাজ বেড়ে যায়। সব কাপড় জামা মেলে দেয় বাঁশের উপর। বড়ি শুকাতে দেয় রাস্তার উপর। আর আমাকে পাহারা দিতে হয়।

সবকিছু কেমন ভিজা ভিজা। সাদিক চাচা, রমজান চাচা সব কেমন কেমন ঝিমিয়ে গেছে। লদির পানি নিয়ে বলাবলি করে। আব্বাও একদম শান্ত। টাউনে না গেলে শুয়েই থাকে, বিড়ি খায়, কাশে। মাঝে মাঝে রমজান চাচার বাড়িতে তাস খেলতে যায়। আর আমাকে দেখলেই হাঁক পারে, ‘কি রে ইলিয়াস পড়ালিখা নাই?’

এই মেঘ বাদলার দিনগুলানে আব্বাকেও তেমন ডর লাগে না। আসলে আমি জানি, আব্বা নিজেই ডরে আছে। পানি লিয়ে, কাম লিয়ে, আরও কি লিয়ে কে জানে।

পানি বাড়ছিল। লদির ধারে বালির মধ্যে যে ভুট্টার গাছগুলান, যেখানে আমরা চোর-চোর খেলি—সব ডুবে গ্যাছে। রমজান চাচা বলছিল “তল কাটছে”। বুঝিনি, দাদি বুঝালো, লদি নাকি রেগে গেলে পার কেটে নেয়। গিলে নেয় জমিন। দাদার আব্বার জমিন নাকি এভাবেই খেয়ে লিয়েছিল লদি।

আমি মা’র সাথেই ঘুমাই এখন। আব্বা মাটিতে। আমাকে দাদির কাছে শুতে হচ্ছে না অনেকদিন। আব্বা এখন মাকে মারে না, সোহাগও করে না। বললাম না, আব্বা ডরে আছে।

কাল রেইতেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।মা’র আগেই শুয়ে যাই আমি। তারপর কখন এসে মা শোয়। ঘুমের মধ্যে আমি বুঝতে পারি মা পাশে শুয়ে আছে। তবে কাল রেইতে কিছু বুঝিনি। ঝটকা মেরে আমাকে কে তুইলে লিলে বিছানা থেকে। আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। দেখলাম আব্বার কোলে আমি, আব্বা ঘরের বাইরে ছুটছে। ঘুম ঘুম চোখে দেখলাম মা, দাদি সবাই হুড়াহুড়ি করছে। টানছে কাপড়, জামা, মুরগীর ঢোপ। টেনে টেনে ঘরের বাইরে আনছে। বাগানের ভিতর আন্ধারে আমকে বসিয়ে দিল আব্বা, “ডর খাস না বাপজান, আইসছি আমরা”।

এই বাগানে আমি ডরি না। এটা আমার চিনা। কিন্তু সবাই এমন ছুটছে ক্যানে? সাদিক চাচা, রমজান চাচা, মোক্তার চাচা সবাই হুড়াহুড়ি করছে। মা’র গলা শুনতে পেলাম, কাঁদছে চিৎকার করে, আর কি সব বলছে। আব্বা কি মারল আবার? দাদি এলো বাগানে। জয়নামাজের কাপড়টার ভিতর কি সব বাঁধা। আব্বা, মা তো একবার করে আসছে আর আমার কাছেই রেখে যাচ্ছে ইস্টোভ, মুরগীর ঢোপ, শাড়ি কাপড়। আব্বার সাথে আসগার চাচা মাথায় করে নিয়ে এলো চকিটাও। এখন আর আন্ধার নাই। হ্যাজাক, লন্ঠন, ব্যাটারির আলোয় বাগানটা এখন ফকফকা আলো। দিনের মতো। গ্রামের সবাই এখন এখানে। খলবল করছে।

কাল রেইতে অনেকক্ষন জেগে ছিলাম। তারপর চকির উপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। এখন আর মেঘ নাই। পরিষ্কার আকাশ।গোটা গ্রামটাই এখন বাগানে। জোগালদার কি দেখেনি? লদি তল কেটে পুরা গ্রামটাকেই গিলে নিল। এখন শান্ত হয়ে আছে। পেত ভরে গেলে যেমন শান্ত হয়ে যায় মুরগিগুলা। গ্রামের দিকে তাকালে শুধু পানি আর পানি। আমাদের ঘরটা কথায় ছিল? আলতাফতদের ঘর? কিছুই বুঝা যেইছে না। এই যাঃ আমার গুলিগুলান? “মা…?” ছুইট্টে যাচ্ছিলাম। দাদি আটকালো, “তোর আব্বা লিয়ে এসেছে। ঐ গাঁটরিতে…” —-ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম ঐ কাপড়গুলির উপর। আর তখনই দাদির গলা শুনলাম, “গুলি তো পাবি, কিন্তু খেলবি কোথায় বাপ? লদি তো সবই গিল্যা লিলে!” ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি দাদির দিকে। বুড়ি কহ্যাই চলেছে, “লদি সব লিয়্যা লিলে, তোর দাদার গোরটাও…”।

সমাপ্ত
সত্যব্রত সিন্‌হা – ‘মেয়েটি’
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India