এসো, নাও— আমাকে ডাকনামে ডেকে মুড়িবাদামের ঠোঙার ওপরকার অর্ধচন্দ্রাকৃতি নারকেলের ফালিটি হাতে ধরিয়ে দিলেন অসীমবাবু। যেন গতকালই দেখা হয়েছে। তাই কুশল জিজ্ঞাসাবাদ ভ্যানতাড়ার তাড়া নেই কিছু— তবু তাঁর এই সহজ চেহারাটি আমাকে ভেতরে ভেতরে কাঁপিয়ে দেয়। সেই কবে, যেন একবার মাত্র শুনেছিলেন আমার মা-কে এই নামে ডাকতে— আশ্চর্য, মনে আছে?
সরকারি স্কুলে, অনেক বাচ্চাদের সঙ্গে আমার ভাইও এসেছিল মায়ের হাত ধরে সেদিন, ভর্তির পরীক্ষা দিতে। সে পর্ব শেষ হতে, প্রায় কুড়ি-বাইশটি বাচ্চা, লাইন দিয়ে হিসি করছিল বেকার ল্যাবরেটরির পাশের ড্রেনে। মজাদার দৃশ্যটি দেখে মায়ের পাশাপাশি হেসে উঠেছি আমিও, ঠিক তখনই হেয়ার স্কুলের পাছদুয়ারে অসীমবাবুর উপস্থিতি। গোল গোল উজ্জ্বল চোখদুটো ক্যাবলা ভাবে বার-দুয়েক ওপর-নীচ করে হাসি হাসি ভঙ্গিতে স্থির হয়ে এল। আলাপ করিয়ে দিতে, মা বললেন, আপনার কথা ও খুব বলে— কিন্তু অসীমবাবুর হেলদোলই নেই কোনও। লেখাপড়া জড়ানো কথা কিছুই হলো না— তা হবার নয়ও, যেন সমবয়সি বন্ধু আমার, এমনই কিছু সৌজন্যকথা শেষ হলে, ঘেঁটো ধুতির ঘুঁটে অসীমবাবু মুখ মুছলেন।
কোনও এক মেঘলা দুপুরে, ক্লাসের ফাঁকে, হেয়ার স্কুলের তেতলার বারান্দায় লেখাপড়া নিয়েই কিসের কথায় যেন এই অসীমবাবুই আমার দিকে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি হেনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, তুমি এখানে কেন এলে?
যে কোনওরকম উপস্থিত অথবা অনুপস্থিত— আলোক সরকারের কবিতার লাইন মনে হতে পারেও হয়ত, তার সঙ্গে মেঘলা দুপুরবেলার যেন একটা অসীম সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল সেইদিনই। অ্যাকাডেমিক লেখাপড়ার সঙ্গে যোগাযোগ নেই তার। ঘেঁটো ধুতি, হলুদ-খয়েরি ঈষৎ মলিন খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা দোহারা চেহারার মাস্টারমশাইটি, মুখে দু-তিনদিনের সাদা দাড়ির কুঁড়ি, তাঁর আনমনা হনহন চলাচলে, কিভাবে যেন মিলে গেল আমার কলেজ স্ট্রীট জড়ানো গতি আর স্থিতির আবেগ। যেন এক্ষুনি শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটের মুখ থেকে বেরিয়ে, কফি হাউসের সামনে কারও অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এই আমার কাঁধে হাত রেখে হঠাৎ বলে উঠবেন, চলো!
এগার ক্লাসে ভর্তি হয়ে অবধি, মানুষটি খুব অন্যরকম আন্দাজ করেই, মন দিয়ে লক্ষ্য করে গেছি। ছোটদের বড় বড় ক্লাসে, ছেলেরা ইচ্ছেমতন হৈহল্লা করছে, গোল্লা পাকিয়ে কাগজ ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে। একদম সামনে বসে থাকা শান্ত-শান্ত পাঁচ ছয়টি ছেলে শুধু শুনছে তাঁর পড়ানো, আর অসীমবাবু তাদেরই বোঝাচ্ছেন মনপ্রাণ ঢেলে। আমাদের ক্লাসেও তার ব্যাতিক্রম হয় কীভাবে? বিখ্যাত সরকারি বাংলা স্কুলে আমি হতভম্ব ব্যাকবেঞ্চার— বাংলায় তাঁর ইংরাজি ক্লাস নেওয়া দেখি। র্যাপিড রিডার থেকে যেন পার্ল বাকের কোনও একটি প্যাসেজ পড়ানো চলছিল। এঁড়ি-গেঁড়ি উদ্বাস্তুরা যেন গোল হয়ে ফেরিওয়ালাকে ঘিরে ন্যুডলস খাচ্ছে। সেই সময় ন্যুডলস বা চাউমিন গোছের ফাস্টফুড তো আমাদের এখানে তত প্রচলিত হয়নি— উনি তার বঙ্গীকরণ করলেন, ফুচকা! গোল হয়ে ঘিরে, ফুচকা খাওয়া … ফুচকা, কি টু-মিনিট-নুডলস-এর সঙ্গেও অসীম কালের হিল্লোলিত সম্পর্ক হলো তাহলে? কুমারপ্রকাশ সেন একদিন কথায় কথায় বোঝালেন, অসীমবাবুর পেছনে কখনও লেগো না কিন্তু, উনি যে সে লোক নন! ট্রিপল এম.এ … আমাদের এখানকার সমস্ত শিক্ষকদের থেকে উনি বেশি কোয়ালিফায়েড …
ক্রমশ প্রকাশ্য...