জন সাধারণের কাছে ছবি অর্থাৎ পেন্টিং পৌঁছে দেবার এক অভিনব পরিকল্পনা থেকেই ১৯৮২ সালে অচিন পটুয়ার যাত্রা শুরু। এই পরিকল্পনার জনক হলেন চিত্রশিল্পী আশীষ গুপ্ত। সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার মধ্যে চিত্রকলার স্থানটা বরাবরই একটু অন্যরকম। শিল্পীরা ছবি আঁকেন এবং সেসব ছবি সংগ্রহ করেন অর্থবান কিছু মানুষ যারা অনেকেই উচ্চকোটি সমাজভুক্ত। চিত্র শিল্পের প্রদর্শনীতে অনেক সমঝদার মানুষ যান, ছবি তারিফ করেন কিন্তু একজন বইপ্রেমী যেমন মনের মত বইটি নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন একজন চিত্রকলা প্রেমীর পক্ষে তার মনের মত ছবিটি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়না। ভাল লাগাটা ঐ প্রদর্শনী কক্ষেই ফেলে আসতে হয়। এর কারণ আমরা সকলেই জানি, ছবির অতুল দাম। তাই পেন্টিং সাধারণের মধ্যে ঠিক ভাবে কখনোই পৌঁছতে পারেনি। বেশ কিছু পরে ছবির প্রিন্টের যুগে সেই প্রিন্টগুলো পৌঁছেছিল। একজন শিল্পীর স্বহস্তে তৈরি পেন্টিং নয়। পেন্টিং মানেই সেটা খুব দামী একটা ব্যাপার সেই ধারণার জন্যে পেন্টিং সংগ্রহ সম্পর্কে মানুষের মনে একটা অনীহা কাজ করে। তাই পেন্টিং সাধারণের কেনা বস্তুর মধ্যে পড়ত না। এখনো বা কতটা পড়ে ? প্রখ্যাত শিল্পী যামিনী রায় পঞ্চাশের দশকে তার নিজের ছবি মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে আনবার জন্যে প্রয়াস নিয়েছিলেন তার ছবির দাম তুলনামূলক ভাবে কম রেখে কিন্তু সেসব ছিল তার স্টুডিয়োর মধ্যেই । ছবিকে একদম রাস্তায় প্রদর্শনী করে, সবার মাঝে মেলে ধরার এই নূতন সম্ভাবনা বাস্তবে এল আশীষ গুপ্তের অচিন পটুয়ার মাধ্যমে। আশীষ গুপ্তের কথায় ‘আমরা চেয়েছিলাম ছবি ও তার সমঝদারের মাধ্যমে একটা সেতু গড়ে উঠুক।‘ ফ্রান্স ও রাশিয়ায় এই ধরণের জনসাধারণের কাছে শিল্পকে প্রচার করার নানা উদ্যোগ দেখা গেছে। সোভিয়েত রাশিয়ায় বাসের মধ্যে ছবি সাজিয়ে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল ও প্রত্যন্ত গ্রামে ভ্রাম্যমাণ গ্যালারির প্রচেষ্টা সাড়া ফেলেছিল। পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত ভারতেও অচিন পটুয়াই প্রথম সাধারণের নাগালের মধ্যে পৌঁছে দেবার উদ্যোগ নেয়।
একদম প্রথম পর্যায়ে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রবীর চক্রবর্তী, মানস রায়চৌধুরী, বরুণ সিমলাই, তড়িৎ চৌধুরী, বিজন চৌধুরী এবং গাইডিং স্পিরিট হিসেবে শুরে থেকেই জুড়ে ছিলেন প্রয়াত সুনীল দাস ও শ্যামল দত্ত রায়। ১৯৮২ সালে অচিন পটুয়া তৈরি হলেও প্রদর্শনী দিয়ে এর যাত্রা শুরু হল ১৯৮৬ তে বিড়লা অ্যাকাডেমীকে। সে বছর সেই দলে যুক্ত হলেন গোপাল দাস, অরিন্দম দত্ত, মলয় কর্মকার ও অন্যান্যরা । এর পরে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত চিত্র প্রদর্শনী হল দিল্লী, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদে এবং অবশ্যই কলকাতায়। ১৯৮৮ তে মুম্বইয়ের এক চিত্র প্রদর্শনীতে আশীস গুপ্তের কবি নীরেন চক্রবর্তীর ‘কলকাতার যীশু’ কবিতা অবলম্বনে আঁকা ছবিটি বিশেষ প্রশংসিত হল। মুম্বইয়ের টাইমস অব ইণ্ডিয়ায় ‘A Talented artist from Bengal’ নামে তার রিভিউ বেরিয়েছিল। অচিন পটুয়া সরাসরি রাস্তায় প্রদর্শনী করল ১৯৯৪ সালে। রাসবিহারীর মোড়ে, কালীঘাট মেট্রোর স্টেশনের দুই বিপরীত দিকের দেওয়ালে এই প্রদর্শনী হয়। সেই থেকে ধারাবাহিক ভাবে হয়ে আসছে এই প্রদর্শনী। অংশ নেয় অনেক তরুণ, তরুণী চিত্রকর। এই প্রদর্শনীর কোনো সময়সীমা থাকে না । প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই চলে এই প্রদর্শনী। রাত বারোটা ও ভোর চারটের সময়েও দর্শক আসেন, থাকেন শিল্পীরা , ছবি নিয়ে আলোচনা চলে এবং চলে বিক্রি। এখানে বর্তমানে ছবির দাম থাকে পাঁচ হাজার থেকে ১৪ হাজারের মধ্যে। গত বছর অচিন পটুয়া ২৫ বছর পূর্ণ করল। ২০ জানুয়ারী উদ্বোধন হচ্ছে এবারের বাৎসরিক প্রদর্শনীর। উদ্বোধন করবেন প্রয়াত শিল্পী সুনীল দাসের সহধর্মিণী গীতা দাস, আসবেন আরো অনেক বিশিষ্ট জন। চলবে ২৩ তারিখ অবধি।
আপনাদের সুবিধে মত চলে আসুন রাসবিহারীর মোড়ে, সঙ্গে আনুন অন্যান্যদের। অচিন পটুয়ার দল থাকবে আপনার অপেক্ষায়।
ধন্যবাদ