অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ৩

কাজ করতে করতেই এ সব বলে চলেছিল ললিতদা। অনূঢ়া জঙ্গলের মাটিতে সে রোপণ করে চলেছে হরেক কিসিম বীজ। খয়ের, চন্দন, বহেড়া, জ্যাকারান্ডা, জারুল আরও কত রকমের বীজ। অত নাম মনে রাখার সাধ্য আমার নেই। একটা শ্যাওলা-ধরা মাকড়া পাথরের নীচের ছায়া-ঘেরা মাটিতে শেষ বীজটি পুঁতে সযত্নে মাটি চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ললিতদা; তারপর হাত নেড়ে তাড়া লাগায়— “চলো হে, চলো এ বার। জোরে পা চালাও। আঁধার গাঢ় হলে আর পথের দিশা মিলবে না। তখন ঘুরতে হবে নিশির ডাকে।”

“নিশির ডাক কী বস্তু ললিতদা?”

“এখনও নিশির নাম শোননি হে? আত্মা গো আত্মা। এ বস্তু ভূত-প্রেত নয়। তোমাদের ওই বিজলিবাতির দেশে নিশি থাকে না। আর বিজলিবাতির বনে ওদের দেখা পাবে না কখনও। নিশি থাকে এই বনে, শাল বনের গহনে। আত্মা, বনপরিদের আত্মা। বড় অসহায় ওরা। গাছের আত্মা। বনের আত্মারাই বনপরি।

rangamati_03

শিল্পীঃ সুদীপ চক্রবর্তী

জানো হে লেখক, এ দিক বড় টাকার আকাল লেগেছে। সবারই দরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সবাই বড়লোক হতে চায়। চাষাভুষো, গাঁয়ের কুলিকামিন, মাস্টার, ডাক্তার, দারোগাবাবু, সেপাই, চৌকিদার সবারই এখন কুনজর এই জঙ্গলে। গাছ বেচলেই নগদ কামাই। এই তো সেদিন এক বিডিও সাহেব জঙ্গল কেটে ১৪৪টা শালগাছ বেচে দিলেন। ডিএফও সাহেব রেইড করে সে সব গাছ উদ্ধার করলেন। বন-বাদা সব সাফ হয়ে যাচ্ছে লেখক। এই নিশিপরির দল তাই রাত হলেই কাঁদে। চাঁদ উঠলেও কাঁদে আবার ঘন আঁধারেও ওরা কেঁদে বেড়ায়। গাছের পাতায় কান পাতো। শুনতে পাবে ওদের কান্না। বড় অসহায় যে ওরা …।” চুপ করে যায় বেরাদা।

“আচ্ছা বেরাদা, তোমার বাড়ি কোথায়?” কথা ঘোরাই আমি।

“দূর বাপু। মানুষের কোনো ঘর আছে নাকি হে? আকাশের নীচে আর মাটির উপরে হল আমার ঘর। তবুও ঠিকা ঠাঁই এক ছিল আমার। সে বহু দূরে। ঝাড়গ্রাম থেকে ১৭ মাইল পুবে বাহিরগাঁয়ে। ছেলেবেলায় বাগাল ছিলাম। গরু-ছাগল চরাতাম। যার নাম ভাতুয়া বাগাল। চাইল্ড লেবার। বংশ-পরম্পরায় দাসখত। বাচ্চার বয়স ৫ বছর হলেই বাবা তাকে সঙ্গে নিয়ে পৌছিয়ে দেবে বাবুদের বাড়িতে। বাবুদের জোত আছে তাই তাদের লেবার প্রয়োজন। বাচ্চাটা হয়ে গেল ভাতুয়া। পেতচুক্তি লেবার। দিনে দু’বার ভাত, আর বছরে ছোট একটা গামছা। কুড়ি বছর বয়স হলে সে ফিরে গিয়ে হবে দিনমজুর। বিয়ে করবে। ছানাপোনা হবে তারাও ওই পাঁচ বছর বয়সে হবে ভাতুয়া। তা আমিও ছিলাম বাগাল। তা এক-দিন নিজের গাঁ ছেড়ে শহরে পালিয়ে এসে ইস্কুলে ভর্তি হলাম। বাবুদের ছেলেরা সবাই গালাগাল দিত। ফুটবল খেলতাম। আমার খেলা দেখে ফরেস্টার সাহেবের মন ভিজল। আমি হয়ে গেলাম ফরেস্ট-গার্ড। প্রথম চাকরি শিমুলপাল বিটে। সে সময় এখানে থাকত  প্রচুর ভাল্লুক। ফাগুনে মহুল ফুল ঝরলে দল বেঁধে ভাল্লুক নামত সমতলে। রাত গভীর হলে শোনা যেত চিতাদের হাঁকডাক, যেন রাজার বাচ্চা। রূপোলী ঝিকমিকে তাদের গায়ের রঙ। তার ওপর কালো কালো ছোপ। সবুজাভ মার্বেল। মানে ওই দু-চোখ ওদের পান্না রঙের। দেখলে মনে হত দলমা পাহাড়ের বাদশা। এই পাহাড়তলির সর্বত্র ওরা দাপিয়ে বেড়াত। সে সব চিতাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত। ( বেলপাহাড়িতে গ্রামের মানুষ ১৯৮৬ সালে একটি চিতাকে খুন করেছিল। বিশাল সেই চিতাটি জঙ্গলের শুকনো পাতায় আগুনের ভয়ে ঢুকে পড়েছিল গ্রামে। গ্রামের মানুষ চোরা শিকারিদের মদতে তাকে পিটিয়ে মারে। পরে ঝাড়গ্রামের রেনজার গড়াইবাবু পুলিশের সাহায্য নিয়ে মৃত চিতার দেহ উদ্ধার করে রেনজ অফিসে আনেন।― লেখক)

“ব্রিটিশ আমলে আইন ছিল কড়া। কিন্তু সাহেবরাই আইন ভাঙতেন। রক্ষকই ভক্ষক। রাজা-বাদশার যুগ, তখন জমিদার, কুঠিয়াল, রাজা, সাহেব, লালবেলাট সবাই আসতেন টেলিস্কোপিক রাইফেল কাঁধে। চলত বেপরোয়া চিতা শিকার। মরত ভাল্লুক, হরিণ, সাপ, হায়না, নেকড়ে। বাবুদের ছিল আগ্রাসী খুনের নেশা। তাদের বেপরোয়া বন্দুকের নিশানায় উজার হয়ে গেছে বনরুই (প্যাঙ্গোলিন) এমনকি শজারু, হরিয়াল, ময়ূরের ঝাঁক। চিতা, হরিণ, পাইথন, বনরুইদের চামড়ার দাম প্রচুর। তা দিয়ে তৈরি হয় মেমসাহেবদের জুতো আর ভ্যানিটি ব্যাগ।

“এখন জমিদারি নেই ঠিকই। কিন্তু জমিদারতনয়রা সব বনে গেছেন ঠিকাদার। তাঁরাই এখানে রাজনীতির নেতা। তাঁদের ক্ষুধার আগ্রাসী মায়াজাল। শাল, পিয়াল, কেঁদ, বহেড়ার জঙ্গল সাফ করে ওরা পুঁজি বাড়াচ্ছে। দলমার জঙ্গল আগামী দিনে মরুভূমি হয়ে যাবে।”

নির্জন শাল বনে জোনাকির মেলা। ললিতদার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি ছড়ায়। বাতাস জঙ্গলে আবদ্ধ হয়ে গুমরে উঠে এমন সব শব্দ সৃষ্টি করছে যে হঠাৎ মনে হয় প্রেতের কান্না। তীব্র হচ্ছে ঝিঁঝিঁর ডাক। ললিতদা বলে চলেছে পুরনো দিনের কথা—

“তোমরা মাঝে মাঝেই লেখ ব্যারেন ল্যান্ড, উইডো সয়েল। অফিসাররাও লেখেন ও সব বিভিন্ন রিপোর্টে। আমার মতে ও সব হল নিপাট মিথ্যে কথা। মাটি কখনও বিধবা হয় না। তা যদি হত তবে কি সাগরগর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এই বিশ্বচরাচরে মানুষের সৃষ্টি হত? ডারউইন সাহেবের বিবর্তনতত্ত্বটাই তো মিথ্যা হয়ে যেত হে বাপু। None of your negative examples generate positive thesis. পরিশ্রম অর্থাৎ মাথার ঘাম পায়ে না ঝরালে ফসল ফলে না। জঙ্গলও হল আবাদি মাটি। গাছেরাও যত্নে সাড়া দেয়। পরিশ্রম না করলে জঙ্গল বাঁচবে কেন?”

“সেই সাহেবদের আমল থেকে ঘুরছি এই দলমার জঙ্গলে; এই জেলা থেকে ওই জেলায়, ওই পাহাড় থেকে সেই পাহাড়ে। দেখলাম হরেক রকমের মানুষ। ১৯৭৮-এ পদোন্নতির ফলে চলে গেলাম উত্তরবাংলার চাপড়ামারি জঙ্গলে। বিপুলাকার অরণ্য, যদিও ঠিক শাল বন নয়। পায়ের নীচে নিটোল সবুজের কার্পেট। নেশা-লাগা সবুজের সমারোহ। এখান থেকে নিয়ে গেলাম গামার, কেন্দু, মহুল, কুরচি আর বহেড়ার বীজ। কেন্দু বিশেষ সাড়া দেয়নি। বাকি গাছগুলো এ বারে গিয়ে দেখলাম অনেক বড় হয়ে গেছে।”

rangamati_04

“১৯৮১-তে গেলাম নাথুয়ার জঙ্গলে। ঘন সবুজের ছাদ। এত সাজানো সুন্দর জঙ্গল আমি আগে কখনও দেখিনি। নীচে ডায়না নদী। তার চরে। খয়েরের জঙ্গল। গ্রীষ্মের দুপুরে নদীর জল থেকে উঠে-আসে ঠাণ্ডা বাতাস শিস কেটে ছুটে বেড়ায় খয়ের গাছের ডালে ডালে। বর্ষাতে ডায়নার কী বিপুল গতর! তারপর গেলাম রাজাভাতখাওয়াতে ট্রেনিং নিতে। গরিব চাষির ঘরে জন্মেছিলাম বাপু, টাকার অভাবে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসতে পারিনি। তো সে বার ফরেস্ট ট্রেনিং-শেষে মিশ্র সাহেব আমার গলায় পরিয়ে দিলেন সোনার মেডেল। ম্যাট্রিক পাশ না করার বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব হল।”

“আবার ফিরলাম নিজের মাটি এই ঝাড়গাঁ-র জঙ্গলে। মাকড়া পাথরে ঘেরা, রাঙামাটি আমার জন্মভূমি। মা-আমার দেশের মাটি। বিভূঁইয়ে যতই দুধে-ভাতে থাকি, ‘মা’র জন্য বুক তো কাঁদেই। মাটির টান তো বাপু রক্তেই বাসা বেঁধে থাকে হে। দূরে থাকা যে বড় বেদনার!”

পথ শেষ হয়ে আসছিল। গাছগাছালির ফাঁকে আঁধার নেমেছে বহু ক্ষণ আগেই। এখন বনে জমাট আঁধার। কেঁদ, বহেড়ার আগায় রাশি রাশি কুয়াশা। তাদের পাতায় শিশিরের মুক্ত বিন্দু। হিমেল বাতাস ঘিরে ধরেছে আমাদের। আকাশে শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদ। গাছের ফাঁক-ফোকর বরাবর যেন আমাদের সমান্তরালে আলোর ঝরনা ঝরিয়ে পথ দেখিয়ে চলেছে। মায়াময় জংলা রাতের নির্জনতা। জোনাক রঙের মিষ্টি আলোমাখা কুয়াশায় স্নান করছিলাম লাকাইসিনির সঙ্গে আমরাও। বাতাসে হিমকুঁড়ির পরশ। মনে হয় শাল বনের নিবিড় আঁধারে নিশির ডাক শুনছে ললিতদা। শুনছে বনপরিদের কান্না। আসলে ললিতদারা আছে বলেই জঙ্গল টিকে আছে আজও।

পথ ক্রমশ সামনে এগিয়ে ঘন শাল বনে ঘেরা নুড়ি-বিছানো চড়াই ভেঙে ক্রমাগত বাঁক ঘুরেই হারিয়ে গেছে পাহাড়চুড়ার চ্যাটালো গামলার মতো উপত্যকার আলো-আঁধারিতে। প্রায় সমতল থাক-কাটা মাটি এখানে। মাঠ আর কুয়াশা একাকার। বহু দূরে আবার ঘন হয়ে পথের কিনারা বেয়ে মন্দ গতিতে নেমে গিয়ে মিশেছে নীচের সমতলের ঘাসজমিতে। শাল বনে মাঝরাতে রঙের রোশনাই থাকে না। শুধুই আলোছায়ার আলপনা। মাঝরাতে সবই সাদা-কালো। নীরব মন্দিরের ঢিমে তাল। মাতাল হিমেল বনের বাতাস ঢেউ তুলে এখন কুয়াশাকে সরাতে চাইছে। কোদালে-কাটা সাদা মেঘ জমছে আকাশে। তার নীচে সাদা আলোর ছেঁড়া ছেঁড়া সিল্যুয়েট। কুয়াশার চাদর ভেদ করে এখন যেখানে উঠে এসেছে সেই শাল বন আলুথালু। পায়ের নীচে অসংখ্য নুড়িপাথর।

হঠাৎ থমকে যায় ললিতদা। ইশারা করে আমাকেও দাঁড়াতে বলে। অজানা আতঙ্কের মুহূর্ত। একটা বরফগলা তীব্র স্রোত যেন নেমে যাচ্ছে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ক্রমশ কোমর, ঊরুদেশ পার হয়ে দু-পায়ের পাতায়। দু-পায়ের গোড়ালি যেন নেমে গিয়ে গেঁথে গেছে পাথুরে মাটির গভীরে। স্থাণুবৎ উদভ্রান্ত আমার কেন্দ্রীয় মগজ। সামনের পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ বেয়ে ধীর গতিতে নেমে আসছে একদল বুনো হাতি। নামছে সাবধানে, খুবই ধীর গতিতে, দুলকি চালে আমাদের বিপরীতে। নুড়িপথে শব্দ উঠছে মুট-মুট-মুট। উতরাই বেয়ে বাঁয়ে পাক খেয়ে নেমে গেল ওরা, বোধহয় দূরের ঝরনার দিকে। মৌনতা ভেঙে ললিতদা বলে― “চলো হে লেখক, আর ভয় নেই। আসলে কী জানো, আজই বিকেলে এই দলে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন এক শিশু গণেশঠাকুর। বাচ্চা নিয়ে মা হাতি আর ধাই-মা আছে আশেপাশেই। বাকি দল গেল খাবার আর জলের খোঁজে।”

উত্তেজনায় অধীর বলি, “চলো তা হলে ছবি করে আনি। দারুণ অভিজ্ঞতা হবে।”

“তুমি তো ভীষণ অবিবেচক হে বাপু। লজ্জা-শরমের বালাই নেই। এক্ষুনি যেতে চাও! তোমার বাড়ির আঁতুড়ঘরে ঢুকতে দাও বাইরের মানুষকে?” ধমকে ওঠে ললিতদা।

সাদামাটা অথচ অকাট্য যুক্তিবোধ। আজন্মলালিত ওর আরণ্যক ব্যক্তিত্ব। হৃদয়গভীরে মমতা-মাখানো অনুভব। ক্যামেরা ব্যাগে চালান করে আমার হাঁটা শুরু করি।

ক্রমশ প্রকাশ্য...
অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ২
অর্ক চৌধুরী – “ রাঙামাটির যুগলপ্রসাদ ” ৪
Close My Cart
Close Wishlist

Close
Navigation
Categories

Add address

India