রাহুল দাশগুপ্ত – “ ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ’ ” ২

village-ivan-bunin-signed-first-nobel_1_46772bfaadd4f654a7f60255cae50bfa

বিপ্লবের খবরে প্রথমে খুশিই হয়েছিল তিখন। কিন্তু বিপ্লবীদের হাতে জমি খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনায় সে ঘোর বিরোধী হয়ে ওঠে। তার মনে হয়, কোথাও বোঝাপড়া নেই। সবাই বিপ্লব, বিপ্লব বলে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু সবকিছু আগের মতোই রয়ে গেছে, নিতান্ত সাদামাটা। মানুষের কথায় বা নিরবতায়, সবকিছুতেই বোঝাপড়ার অভাব! পাখির গান, মাটির প্রশান্তি, ফুলের গন্ধ সবকিছুই আগের মতোই আছে। তিখন বিপ্লবীদের জন্য অপেক্ষা করে, তারা এলে গর্জন করে, তার শূন্যে ছোড়া গুলি আপেল বাগানে গিয়ে পড়ে, গোটা উয়েজদ জেলায় বিপ্লব ছড়িয়ে যায়, চাষীরা বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয়, বেশ কয়েকটি জমিদারী দখল করে, জমিদারেরা পালিয়ে গিয়ে সরকারের কাছ থেকে সাহায্যের আশায় শহরের হোটেলগুলিতে গিয়ে ভিড় করে। বিপ্লবের পর জমিদারদের অবস্থা হয় শোচনীয়। তাদের অনেকেই অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটায়, শেষ সম্বলটুকু বেচে দেয়, ভাঙা জানলা বা ফুটো ছাদ সারাইয়ের অর্থ পর্যন্ত জোটাতে পারে না। অন্যদিকে নতুন একটা শব্দ খুব শোনা যায়। প্রলেতারিয়েত। এদের খাবার জোটে না, এদিকে বই কিনতে ফতুর হয়ে যায়। আর কী সব বই! এ এমন এক দুনিয়া, যেখানে, পকেটে পয়সা থাকলে তবেই তুমি দুনিয়ার মাথায় চড়ে বসতে পারবে।

     বিপ্লবের পর সব শান্ত হয়ে গেলে, তিখন আবার বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার জমিদারীতে আশ্রিতা রোদকার স্ত্রী ইভদোকিয়াকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণও করে। কিন্তু বাবা হওয়ার স্বপ্ন তার কাছে অপূর্ণই থেকে যায়। এরপরই তিখন নিজের ভাই কুজমাকে শহর থেকে ডেকে আনে এবং নিজের জমিদারীর ম্যানেজারের ভার দেয়। হতদরিদ্র, রিক্ত, দুর্দশাগ্রস্ত ছবি সেই জমিদারীর। একজন সুস্থ স্ত্রী, উষ্ণ ঘর, হইচই করা সন্তান, এই সমস্ত কিছুর স্বপ্ন চিরকাল স্বপ্ন হয়েই থেকে যায় তিখনের কাছে। নিজের স্ত্রী পর্যন্ত সারাজীবন তার কাছে অচেনাই থেকে যায়, সে কেমন মানুষ কোনওদিন তার খোঁজ নেয় না সে। এখন ঘন ঘন তার মনে আসে শুধু মৃত্যুচিন্তা। আর অতীতের টুকরো টুকরো ঝলমলে স্মৃতি। আত্মহত্যার কথাও মনে হয়। বার্ধক্য ও মৃত্যুর কোনও সান্ত্বনা নেই তার কাছে। সবসময় আত্মকরুণায় ভরে থাকে মন। জীবন খুব দ্রুত কেটে যায়, মানুষ মানুষকে স্রেফ ওপর ওপর চেনে, আর সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি ভুলেও যায়। দশ বছরকে মনে হয় সামান্য কয়েকটা দিন। এই কী জীবন! শান্তি ও স্তব্ধতার মধ্যেও তাই বিষণ্ণতা ছাড়া আর কিছুই বোধ করে না তিখন।

     কাহিনী এবার আবর্তিত হয় কুজমাকে ঘিরে। নিজের দেশ ও মানুষ নিয়ে কুজমার মধ্যেও কোনও মোহ নেই। সে তার ভাইকে স্পষ্ট জানায়, এ দেশের মানুষ বন্য ও বর্বর। তারা শুয়োরের মতো বেঁচে আছে, পচে যাচ্ছে এবং শুয়োরের মতোই বেঁচে থাকবে। এটাই তাদের বেঁচে থাকার রীতি। গোটা দেশের ইতিহাস শুধু খুন আর বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ণ। এখানে কেউ সারল্য দেখাতে গেলে ডাকাতি করার চেয়েও বেশি অপরাধ করবে। গোটা দুনিয়ায় এরকম দরিদ্র দেশ আর নেই। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এত ইতর ব্যবহারও আর কোনও দেশে করা হয় না। দারিদ্রকে এখানে সহ্যসীমার শেষ প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়। তোমার খাওয়ার মতো কিছু না থাকলে তুমি চিন্তা করবে কী করে? গোটা দেশ ভরে গেছে ভিখারি আর বেশ্যায়। এখানে মেয়েরা হাতে রুটি নিয়ে পুরুষের শরীরের নিচে শুয়ে পড়ে। এভাবে প্রথম রুশ বিপ্লবের সময়কার রাশিয়ার বর্ণনা দেন বুনিন।

     কুজমা সারাজীবন শুধু পড়ালেখাই করতে চেয়েছে। তিখনের কাছে জীবন অন্তঃসারশূন্য। কুজমার কাছে জীবন অতি সাধারণ। আর এই সাধারণত্বই তাকে পীড়া দেয় সবসময়। জীবনের এই সাধারণত্ব মানুষের বিকাশের পক্ষে সহায়ক নয়। এরকম পরিবেশ, দারিদ্রে আর অভাবে, মানুষ কুঁকড়ে থাকে সবসময়। কুজমাও কুঁকড়ে গেছে। জীবনের শিক্ষা সে পেয়েছিল বৃদ্ধ অ্যাকর্ডিয়ন বাদক বালাশকিনের কাছে। এই লোকটি ছিল খামখেয়ালি আর মুক্তচিন্তাকে প্রশ্রয় দিত। বালাশকিনই তাকে শিলার আর তুর্গেনেভের ‘স্মোক’ পড়তে দেয়। তাকে বোঝায় সে এমন এক দেশের বাসিন্দা, যেখানে পুশকিন আর লেরমন্তভ জাতির চিরশ্রেষ্ঠ দুই কবিকে হত্যা করা হয়েছে। অসামান্য ভাবুক, জর্জ প্লেখানভ এবং লেলিনের গুরু, দিমিত্রি পিসারভ জলে ডুবে মারা গেছে। ডিসেন্ত্রিস্ট বিদ্রোহের নেতা এবং রুশ কবি কনদ্রাতি রিলেয়েভকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, হাতে বায়রনের কবিতার বই নিয়ে তিনি বধ্যভূমিতে যান এবং আবেদন করেন, তাঁর দেশ খুবই অসুখী এবং গোটা বিদ্রোহের জন্য তিনি একাই দায়ী, তাঁকে একাই যেন শাস্তি দেওয়া হয়। দস্তয়েভস্কি ও গোগোল, মহত্তম দুই গদ্যকার, কী পরিণতি হয়েছে তাঁদের? প্রথমজনকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, দ্বিতীয়জনকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে উন্মাদ হওয়ার দিকে। ইউক্রেনের জাতীয় কবি তারাস শেভচেঙ্কো আর জারকে যিনি ‘ফাঁসুড়ে’ বলেছিলেন, সেই বিদ্রোহী রুশ কবি আলেকজান্দার পলিঝায়েভের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। দুনিয়ায় এরকম দেশ কী আর একটাও আছে?

     রুশ সাহিত্যের বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কুজমার সঙ্গে বালাশকিনের কথাবার্তা হয়। দস্তয়েভস্কির ‘কারামাজভ ব্রাদার্স’এর কারামাজভ, ইভান গনচারভের ‘ওবলামভ’, লেভ তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর প্লাতোন কারাতায়েভ, ‘কসাক’-এর ইয়েরোশকা, লুকাশকা, গোগলের ‘দি গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর’য়ের খেলেশতাকভ, ‘ডেড সোলস’-এর নোজদ্রেভ এইরকম। শ্চেদ্রিনের স্যাটায়ার এবং তলস্তয়ের প্রবন্ধ পড়ে কুজমার সময় কাটে আর কেবলই মনে হতে থাকে, জীবনটা কোনও কাজেই এল না, স্রেফ পণ্ডশ্রম করেই কেটে গেল। মৃত্যুর আগে বালাশকিন কুজমাকে পরামর্শ দিয়ে যায়, জীবনের প্রতিটি ঘণ্টায় কিছু না কিছু শেখো, কিছু ভাবো, আর চারপাশের দুর্ভাগ্য আর দুর্দশার দিকে তাকিয়ে দেখো। কুজমাকে সর্বক্ষণ পড়াশুনো করতেই দেখা যেত, অভিশপ্ত রুশ জীবনের নানা টুকরো, কখনও জুড়ছে, আবার কখনও বাদ দিচ্ছে। তলস্তয়ের ‘কনফেশন’ পাঠ করে টানা এক বছর কুজমা ধূমপা, ভোদকা পান বা মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন। গোগলের কথা তার মনে পড়ে। কিন্তু জীবনের সাধারণত্ব ভেতরে ভেতরে তাকে তিতিবিরক্ত করে তুলতে থাকে।

     ভাই তিখনের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার আগে পর্যন্ত ভবঘুরে জীবনই কাটিয়েছে কুজমা। রাশিয়া ও তার মানুষকে দেখেছে খুব কাছ থেকে। পেটের দায়ে নানা রকম কাজ করতে হয়েছে তাকে। ট্রেনে যেতে যেতে শুনেছে বিপ্লব আর দুর্ভিক্ষের কথা। কুজমার এই ভবঘুরে জীবনের সুত্রে রাশিয়ার খুঁটিনাটি অথচ বৈচিত্রপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন বুনিন। দরিদ্র মানুষ এখানে শীতের হাত থেকে বাঁচতে গোবরের স্তূপে নিজের শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। পনেরো কোপেকের জন্য গরীব চাষী জমিদারের কাছে নিজের স্ত্রীকে বেচে দেয়, যদিও একাজ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কুজমার মনে হয় শহর থেকে গ্রামে এসে রাতারাতি সে বুড়িয়ে গেছে, অসভ্য হয়ে উঠেছে, কয়েকটা দিনকে মনে হয় বহু বছরের সমান। শহর থেকে গ্রামের দূরত্ব এতটাই। ক্ষুধা ও নানা জটিল চিন্তায় কাতর হয়ে ওঠে সে। শুধুমাত্র বই হয়ে ওঠে তার নিত্য সঙ্গী। রুটির অভাব ছাড়াও মোমবাতির অভাবে বই পড়াও ক্রমে কঠিন হয়ে ওঠে।

ক্রমশ প্রকাশ্য...
রাহুল দাশগুপ্ত – “ ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ’ ” ১
রাহুল দাশগুপ্ত – “ ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ’ ” ৩
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India