রাহুল দাশগুপ্ত – “ ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ’ ” ১

Ivan Buninইভান বুনিনের ‘ দি ভিলেজ ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। ওই বছরই লেভ তলস্তয় মারা যান। আন্তন চেকভ মারা গেছেন ১৯০৪ সালে। ম্যাক্সিম গোর্কি এই উপন্যাসটির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং চেকভের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে বুনিনকে চিহ্নিত করেন। এই উপন্যাস সম্পর্কে বুনিন নিজে লিখেছেন, ‘ আমি গ্রামজীবন নিয়ে কাহিনি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা ছাড়াও আমি সাধারণভাবে রুশ জীবনের ছবিও দেখাতে চেয়েছিলাম।’ রাশিয়াকে গভীরভাবে জানতেন বুনিন। এই উপন্যাসে তিনি মন্তব্য করেছেন, গোটা রাশিয়াই আসলে একটা গ্রাম। সারা জীবন একথা মনে রেখো।’ দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, চেকভ বা গোর্কির মতো মহৎ দার্শনিক লেখকেরাও সম্ভবত রুশ মাটির, জনজীবনের এত গভীরে প্রবেশ করতে পারেননি। এদের বেশিরভাগ লেখাই নগরকেন্দ্রিক। বুনিন যেভাবে রাশিয়ার গ্রামকে তুলে এনেছেন, সেখানকার মানুষের বসবাসের স্থান, পোশাক, খাদ্য, অভ্যাস, আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন, তা ছিল রুশ সাহিত্যে এক অভিনব ব্যাপার। বুনিনের গদ্যে কবিতা আর সঙ্গীত মিলেমিশে যায়, এক বিধ্বস্ত, অশান্ত জীবনের ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বিষণ্ণ গীতিময়তায়। এই জন্যই গর্কি বলেছিলেন, ‘ফর মি, ইউ আর এ গ্রেট পোয়েট।’

     ১৯৩৩ সালে প্রথম রুশ লেখক হিসাবে নোবেল পুরস্কার পান বুনিন। ১৯৩৭ সালে স্তালিন জমানায় ইভান বুনিনকে ‘ক্লাসিক রাশিয়ান রাইটার’ বলে জনসমক্ষে উল্লেখ করার অপরাধে ভারলেম শালামভকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সতেরো বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। মুক্তি পাওয়ার পর শালামভ কিন্তু আলেকসান্দার সলঝেনিৎসিনের সঙ্গে ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’র সহযোগী লেখক হতে রাজি হননি, কারণ, সলঝেনিৎসিনকে তিনি নিজের তুলনায় নিকৃষ্ট লেখক বলে মনে করতেন। সলঝেনিৎসিন অবশ্য শালামভের মহত্বকে স্বীকার করে অকুণ্ঠভাবে লিখেছিলেন, ‘শালামভ’স এক্সপেরিয়েন্স ইন দ্য ক্যাম্পস ওয়াজ লংগার অ্যান্ড মোর বিটার দ্যান মাই ওন’। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, স্তালিন-যুগেও ইভান বুনিন কতটা প্রভাবশালী লেখক ছিলেন এবং যদিও তিনি বহুদিন আগেই দেশত্যাগ করেছিলেন তথাপি তাঁর সম্পর্কে তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের কী প্রবল ভীতি ছিল! বুনিনের রচনা যে কতটা সত্যনিষ্ঠ ছিল, তা এই ভীতির পরিমাণ দেখেই বোঝা যায়!

     ‘দি ভিলেজ’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে আছে ১৯০৫ সালের প্রথম রুশ বিপ্লব। তিখন আর কুজমা নামে দুই বয়স্ক ভাইয়ের কাহিনি আছে এতে। দুই ভাই যেন দুই গোলার্ধ, আর এই দু’জনকে নিয়েই গোটা রাশিয়া। এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন একজন ভূমিদাস। ১৮৬১ সালে রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা লোপ পায়। তিখন দুরনোভকা নামে জমিদারির মালিক, কুজমা সেই জমিদারির ম্যানেজার। ‘দুরনোভকা’ কথাটির অর্থ ‘খারাপ’ বা ‘অশুভ’। তিখন বাস্তববাদী, পরিশ্রমী, বস্তুবাদী, নিষ্ঠুর আর আগ্রাসী। কুজমা ভাবুক, স্বপ্নদ্রষ্টা, পড়ুয়া, শিক্ষিত, হৃদয়বান, সংবেদনশীল। তিখন সারাজীবন প্রেমহীনতায় ভোগে, দরকার হলে জোর করে দখল করে নিতে চায়। কুজমা প্রেমকে নিভৃতে লালন করে, তাকে গভীরে অনুভব করে। দুরনোভকা কোনও সহজ জায়গা নয়, তা হিংসা, অশান্তি ও নিয়মহীনতায় পরিপূর্ণ। এখানে অজ্ঞানতা, ঘৃণা, দারিদ্র, নোংরা, নিষ্ঠুরতা, আলস্য নিত্য বিরাজমান। প্রথম রুশ বিপ্লবের সময়কার রাশিয়ার প্রকৃত বাস্তবতা মূর্ত হয়ে উঠেছে এই আখ্যানে। একজন ভূমিদাসের দুই উত্তরপুরুষ, তাদের একজন নিজেই হয়ে উঠেছে সামন্তপ্রভু, অন্যজন মধ্যবিত্ত, চাকুরীজীবী, নাগরিক বুদ্ধিজীবী, একজন অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়েছে, অন্যজন ভবিষ্যতের, আর এই দুইয়ের সহাবস্থানেই গড়ে তুলছে রাশিয়ার তৎকালীন বর্তমানকে।

     লেভ তলস্তয় ‘আন্না ক্যারেনিনা’ উপন্যাসে এবং আস্তন চেকভ ‘ দি চেরি আর্চর্ড’ নাটকে যুগ সন্ধিক্ষণের ছবি এঁকেছেন। দেখিয়েছেন, সামন্তবাদী রাশিয়া কীভাবে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী, শিল্পোন্নত রাশিয়ায় বদলে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কী বদলে যাচ্ছে? সামন্তবাদী সমাজের আসল কাঠামোটি কী একইরকম থেকে যায়নি? যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা শুধুমাত্র বাইরের প্রলেপ, নগরে এবং মুষ্টিমেয় নাগরিক জীবনে? এই প্রশ্নই যেন এই উপন্যাসে তুলেছেন বুনিন। উপন্যাসের প্রথম পর্বে তিখনের চরিত্রটি ছোটো ছোটো আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। খুবই তীক্ষ্ণ তার স্বভাব। চারপাশের গরিব মানুষকে আস্ত নির্বোধ বলেই সে মনে করে। নিজের কোনও সন্তান নেই তিখনের। সারাজীবন ধরে প্রচুর সম্পত্তি জমিয়েছে সে। কিন্তু এসবই তার কাছে বোঝার মতো মনে হয়। স্ত্রী অসুস্থ, তাকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে সে ক্লান্ত। জীবনটাই তার কাছে অসাড়, অর্থহীন বলে মনে হয়।

     দুরনোভকা জায়গাটিও বিষণ্ণ, ঠাণ্ডা, নোংরা আর অন্ধকার। একজন জীবিত মানুষের সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। প্রতি পাঁচ বছরে এখানে একবার করে দুর্ভিক্ষ হয়। তিখনের দোকানে নানা ধরণের মানুষ আসে। ভিখিরি, ভবঘুরে, ছোটো ব্যবসায়ী, ভাড়াটে মেয়ে, রাতের পাহারাদার, গাড়িচালক, ঠিকে মজুর, নামহীন সব মানুষ। এইসব অভাবী, নিপীড়িত মানুষের মধ্যে রয়েছে যুগ-যুগান্তরের ঐতিহ্য, তাদের মাটির প্রতি সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির সঙ্গে সংলগ্নতা, জীবনের প্রতি ভালোবাসা, বিনীত-অবদমিত স্বভাবকেই তুলে ধরেছেন বুনিন। তিনি যেমন তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেননি, তেমনই তাদের মহৎ করেও দেখাননি, কোনও আবেগ প্রকাশ করেননি তাদের নিয়ে, বরং গভীর ভালোবাসায় তাদের চারপাশের অন্ধকার, হিংসা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যেও তাদের অপাপবিদ্ধতাকেই দেখিয়েছেন, চারপাশের দুনিয়ার চালাকি ও দুর্নীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে এক বদ্ধ জীবনে তাদের বেঁচে থাকার নিষ্পাপতাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন।

     এত অভাব, দারিদ্র, নিচতা ও ক্ষুদ্রতার মধ্যেও বুনিন কবিতা ও সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন, এমনই তাঁর সৌন্দর্যবোধ, বিশেষ করে প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়ার বর্ণনায় তিনি যে কোমল, সূক্ষ্ম, পেলব স্পর্শ দিয়েছেন, তা নিশ্চিতভাবেই মার্সেল প্রুস্তকে মনে করিয়ে দিতে পারে। মেলায় গিয়ে তিখনের চোখ দিয়ে যেন রাশিয়াকেই দেখিয়েছেন তিনি। তিখন গেছে অস্বাস্থ্যকর হাসপাতালে, নোংরা, বিবর্ণ চার্চে আর সমাধিস্থানে। মৃত্যু ও ক্ষয়ের ছবি দেখে আঁতকে উঠেছে। সমাধির গায়ে লেখা শান্তি, প্রেম ও বিশ্রামের কথাগুলো তার কাছে অসত্য বলে মনে হয়েছে। এক বৃদ্ধ মহিলার কাছে রূপকথার গল্প শুনেছে। নারী তীর্থযাত্রী ও মাতাল জনতার মুখোমুখি হয়েছে। চাষিরা নগ্ন ও ক্ষুধার্ত। যাজক অর্থলোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত। চারপাশের দারিদ্র দেখে তিখনের মনে হয়েছে, একজন জবরদস্ত মালিকের প্রয়োজন যে সব ঠিক করে দেবে এবং এই দুনিয়ার সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি হল, ব্যবসা। এভাবেই পুরনো যুগের সান্ততান্ত্রিক ও নতুন যুগের পুঁজিবাদী প্রভাব মিলেমিশে গেছে তার মানসিকতায়।

ক্রমশ প্রকাশ্য...
চয়ঞ্জীব শূর – “ এই সময় ”
রাহুল দাশগুপ্ত – “ ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ’ ” ২
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India