৫
দূরে দূরে ছোটো কয়েকটা টিলা। পশ্চিমের টিলার পেছন থেকে কমলা আলোর বলটাকে আস্তে আস্তে নেমে যেতে দেখল ফুল্লরা। সূর্য ডুবছে। আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখানকার বউরা মাথায় কলশি নিয়ে চলতে পারে। সেটা এখনও অভ্যাস হয়নি। সে কলশি নেয় কাঁখে। প্রথম প্রথম এত ভারী কলশি বইতে পারত না, একবার তো জলভরা কলশি দরজার কাছে পর্যন্ত এনে ফেলে দিয়েছিল। সেজন্য আশাবাই খুব মেরেছিল তাকে। রাতে খেতেও দেয়নি। গায়ের ব্যথায় সে পরেরদিন উঠতে পারেনি, জল আনাও হয়নি। সেই থেকে আশাবাই তাকে মারে না, কিন্তু বোলি বড়ো তীক্ষ্ণ তার।
চাবুকের মতো সপাং করে গায়ে বেঁধে।
কিষণলাল বলে যে-লোকটা তার স্বামী, সে অবশ্য কিছু বলে না। উঠোনে পাতা চৌপাইতে বসে শুধু চোখ দিয়ে অনুসরণ করে তাকে। সে দৃষ্টি দেখলেই গা ছমছম করে ফুল্লরার। কারণ কিষণলাল তাকে যে দেখছে, সেটা আবার আশাবাই-এর নজর এড়ায় না। একসঙ্গে দুজোড়া চোখের ভার বহন করা কঠিন।
অন্যদিন ঠাঁ ঠাঁ দুপুর রোদে সে ফেরে। আজ রোদ পড়ে গেছে। অত কষ্ট হচ্ছে না তার। কিন্তু মাসিক শুরু হওয়ায় কোমরে সে আর কলশি রাখতে পারছে না। এবার থেকে এদেশের বউ-ঝিদের মতো মাথায় কলশি বওয়া অভ্যাস করতে হবে তাকে।
রোদ নেই। তবু কলশি নামিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা গাছের ছায়া খুঁজল ফুল্লরা। গাছ, গাছের ছায়া তাকে বাংলার কথা, নদীর কথা, মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেই বিয়ের দিন মাকে একবার ফোন করেছিল ভগবান চাচাকে ধরে করে। তারপর কত দিন, কত মাস হয়ে গেল কোনও খোঁজ খবর নেই। কিষণলালের একটা মোবাইল আছে, সারাক্ষণ সে সেটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোনও বরসাতের রাতে সে যদি ফুল্লরার শরীর চায়, তাহলে, কিষণলালের মোবাইল নাগালে পেয়েও, মাকে ফোন করা হবে না ফুল্লরার। মার তো ফোন নেই। মাকে ফোন করতে হবে দিনের বেলা, মা যখন কারও বাড়ি কাজ করে। জল আনতে আসা-যাওয়ার পথে কোনও বাজার পড়ে না, যে সেখানে একটা ফোনের বুথ খুঁজে ফোন করতে পারে। তার কাছে অবশ্য পয়সা নেই, পানিবাইরা তো পেটখোরাকি, হাতে পয়সা পায় না। কিন্তু তার নাকে এককুচি রুপোর নাকফুল আছে, বাবার শেষ স্মৃতি। ফোনের বুথ পেলে ওই ফুল দিয়ে সে মাকে ফোন করবে। মা যেন ধলাদাদুকে পাঠিয়ে তাকে এখান থেকে নিয়ে যায়।
খুঁজতে খুঁজতে ফুল্লরা দেখল দূরে একটা শিমূল গাছ। মাংসল লাল ফুলে ছেয়ে আছে। শিমূল ফুল ফুটেছে। তার মানে এটা বসন্তকাল! আর কদিন পরেই বৈশাখ মাস পড়বে, তাদের হরিসভায় মোচ্ছব হবে, তাদের পাড়ার মেয়েরা সেজেগুজে গিয়ে কত মজা করবে, শুধু সে-ই থাকবে না। সবাই জানবে যে শাহরুখ খানের …
হঠাৎ শিমূলফুলের রং দেখে বুক ধক্ করে ওঠে ফুল্লরার। বসন্ত এসে গেছে! তার মানে একদিন বর্ষাও আসবে। আশাবাই-এর আবার গর্ভ হয়েছে, বুড়ি, যার নাম যশোমতী জানিয়েছে তাকে। বর্ষাকালেই হয়তো সে মাইকে যাবে। সেইসময়, অন্ধকার রাতে, কিষণলালের বুকে তৃষ্ণা জেগে ওঠে যদি? বাংলার শ্যামল-সবুজ জল-ছলছল শরীর পান করার সাধ জাগে তার? যশোমতী বলেছে তাতে অন্যায় কিছু নেই। কিষাণলাল তো তার শাদি করা মরদ, সে তার শরীর নিতেই পারে। কিন্তু আশাবাই-এর মতো ঘর বা বিছানা সে পাবে না কোনওদিন। কিন্তু কিষাণলালের ইচ্ছেয় সায় দিলে আখেরে তারই ভালো। যখন ফুল্লরা একদিন বুড়ি হয়ে যাবে যশোমতীর মতো, আর পানি আনতে পারবে না দূর গাঁও থেকে, তখন কিষণলালের মনে জাগরূক থাকতে পারে তার শরীরের স্মৃতি, সে হয়তো তাড়াবে না ফুল্লরাকে। তা না হলে রাস্তায় রাস্তায় ভিখ মেগে বেড়াতে হবে তাকে।
ফুল্লরা কি তাহলে সারাজীবন জল বয়ে আনবে একটা সংসারের জন্য, যে-সংসারটা তার নয়। তার নিজের আনা জলে দু-ঢোঁকের বেশি অধিকার থাকবে না তার? জল আনতে আনতে যশোমতীর মতো বুড়ি হয়ে যাবে সে? তখন তাকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে, যদি না কোনও বরসাতের রাতে কিষাণলালের ইচ্ছেয় সে সাড়া দেয়?
ভাবতেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে। শিমূল ফুলের টকটকে লাল রং যেন বিপদ সংকেতের মতো তার চোখের সামনে নাচতে থাকে। বসন্ত থেকে বর্ষা আর কতই বা দূর। তাকে পালাতে হবে। তাকে এখনি পালাতে হবে।
দৌড় শুরু করার আগে সে নিজের আনা জল, কলশি কাত করে আঁজলা ভরে আশ মিটিয়ে খেয়ে নেয়। তারপর ধাক্কা মেরে উলটে দেয় কলশিটা। জল মাটিতে গড়িয়ে যায়, শুখা মাটি তা শুষে নেয় মুহূর্তে।
৬
অনেকক্ষণ থেকে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিলেন ইনস্পেকটর ঘোসলে। মেয়েটার সাজপোশাক মারাঠি গাঁয়ের বউয়ের মতো, কিন্তু ওর সবুজ পানপাতার মতো মুখ, নরম চাউনি বলে দিচ্ছে ও বাঙালি। কিছুক্ষণ আগে তিনি এক দল বাঙালি মেয়েকে উদ্ধার করেছেন মুম্বইয়ের এক কুখ্যাত কোঠি থেকে। এদের কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দুজন প্রতিনিধি এসেছে কলকাতা থেকে। তিনি নীচুগলায় তাদের সঙ্গে কীসব বলেন…
হাওড়া স্টেশনে ট্রেনটা থামার পর টিভি ক্যামেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েগুলোর ওপর। সাবাই ওড়না বা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফেলল অমনি। শুধু একটা মেয়ে উদাসীন মুখে বসেছিল। সাংবাদিকের হাজার প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু একটাই কথা বলল, ‘পানিবাই’।
৭
আবার ইস্কুলের সামনের টিউকল থেকে জল নিতে এসেছে ফুল্লরা। আগে যেমন আসত। কিন্তু ঠিক আগের মতো যে আর সবকিছু নেই তা সে বুঝতে পারছে। আগের মতো জলের জন্য সবার পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে বটে, কিন্তু আগে তাকে দেখে বউদের এরকম কানাকানি, গা-টেপাটেপি ছিল না। সেদিন হাওড়া ষ্টেশনের ছবি অনেকেই দেখেছে টিভিতে। ওকে মুম্বইয়ের কোঠি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, এরকম একটা খবর রটে গেছে চারদিকে। তাতে নতুন করে কিছু ক্ষতি হয়নি, আগেও ওরা একটেরে কাওরাপাড়ায় আধপেটা খেয়ে থাকত, এখনও তাই। মায়ের কাজগুলোও যায়নি, বরঞ্চ তার মেয়ের মুখ টিভিতে দেখা গেছে বলে খানিকটা সমীহ তৈরি হয়েছে। তবে সবাই সনকাকে বলছে, ‘আগেই তোমাকে বলেছিলাম, শুনলে না।’
তবে লাভ একটা হয়েছে, কলকাতা থেকে ভালো শাড়ি-জামা পরা, চশমা চোখে একদল মহিলা দামি গাড়ি চেপে এসেছিল শুধু ওর সঙ্গে কথা বলতে। তারা ওকে শহরের মহিলা স্বনির্ভর কেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে। কাজ শেখার পাশাপাশি কিছু রোজগারও হবে।
সবার জল নেওয়া হয়ে গেছে ভেবে ফুল্লরা তাড়াতাড়ি তার প্লাস্টিকের বোতল কলের মুখে বসাতে গেল। ঘোষেদের মেজোবউয়ের যে আর একটা বোতল বাকি আছে সে দেখতে পায়নি। মেজোবউ অমনি খরখরে গলায় বলে ওঠে, ‘আরে ছুঁড়ি, মর মর। তোকে ছুঁয়ে আবার অবেলায় চান করব নাকি? একে কাওরা-হাঁড়ি, তারওপর দিল্লি বোম্বে সৃষ্টি জজিয়ে এসেছিস!’
শুনে শুনে অভ্যস্ত, তবু খামোখা চোখে জল এল ফুল্লরার। কয়েক মাস আগেও তার আনা জলের জন্য হাঁ করে থাকত আশাবাই আর তার ছেলেমেয়েরা। কিষণলাল লোটা ভরে পানি খেয়ে তৃপ্তিতে বলত, ‘আঃ’। ফুল্লরা বাড়ির জন্য কান্নাকাটি করলে যশোমতী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘লোককে পানি পালানো বড়ো পুণ্যের কাজ রে। পানিবাই কি যে সে হতে পারে?’ কয়েক মাসের তফাতে, সেই একই জল, তার ছোঁয়ায় অশুদ্ধ হয়ে গেল!
সমাপ্ত