শুভংকর গুহ – “ মানুষের মাংস ” ১

Subhankar Guha1

শিল্পীঃ সুদীপ চক্রবর্তী

আজ রবিবার। সকালে, নরহরিকে ঘরেরে দক্ষিণ দিকের জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রমীলা মনে মনে আগুন হয়ে গেল। এই সাতসকালে ওখানে নরহরির দাঁড়ানোর কথা নয়। কী করছে এখন ওখানে মানুষটা? দুপুরবেলায় ওই জানালাটির কাছে প্রমীলা দাঁড়াবে। সংসারের সমস্ত কাজের শেষে, ক্লান্তিতে পান চিবোবে আর পানের পিক্ ফেলবে।

     একটাই ঘর নরহরির। ঘরটির বাঁদিকে আট ফুট বাই আট ফুটের একটি রান্নাঘর। রান্নাঘরে জানলা নেই। আছে দুটি ভেন্টিলেটার। দিনের আলো ঢোকে না। আলো জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়। সংসারে তিনটি প্রাণী। নরহরি, প্রমীলা আর কিশোর বয়সের একটি ছেলে, নাম খোকন। ভালো নাম আর ডাক বলতে ওই একটিই। রান্নাঘরের ভেতরে অনেক জঞ্জাল। খবরের কাগজ, ঘুটের বস্তা, নারকোলের খোল, তেলের পাউচ, ইঁদুর মারার কল, লণ্ঠনের চিমনি, চালের টিন, ছেঁড়া চামড়ার হাওয়াই চটি, স্নান করার বালতি এবং ছেঁড়া জুতো ও চপ্পল।

     প্রমীলা প্রায় রোজ খিচ্ খিচ্ করে। নরহরিকে রান্নাঘর থেকে এসব আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে বলে। নরহরিও তর্ক করে না। বলে, কাল করব-  বলতে-বলতে মাস গড়িয়ে যায়। রান্নার ঘর ছাড়া আর সেই একটিই ঘর। এই ঘরেই প্রমীলা এবং নরহরির স্বপ্ন, আশা, ক্ষুধা, লালসা, ক্রোধ, অভাব অনটন ও টানাটানির সংসার রোজ ঘুমিয়ে পড়ে আবার সকালে জেগে ওঠে। ঘরে দুটি জানলা আছে। একটি উত্তর দিকে আরেকটি দক্ষিণ দিকের দিকে। দক্ষিণ দিকের জানলাটি প্রমীলার পছন্দ। তাই সে সবসময় দক্ষিণ দিকের জানলা দিয়ে ঘরের বাইরে পৃথিবীটাকে দেখতে-দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। উত্তরদিকের জানলার পাশেই দরজা। দরজার ডানদিকে হুকে ঝোলানো আছে নতুন একটি ছাতা। ঘরের আসবাবপত্রের মধ্যে ছাতাটা এখন নবীন অতিথি। গেল সপ্তাহে নরহরি কিনে এনেছে। অপেক্ষা করছে, বৃষ্টির ফোঁটার জন্য। গত বছরের বৃষ্টির মরশুমে তাকে কাক-ভেজা ভিজতে হয়েছে। দৈনিক বাজারের বাজেট কমিয়ে ছাতাটা কেনার অর্থ যোগাড় করেছে একজন পাকা অর্থমন্ত্রীর মত।

     প্রমীলা বলে- ওখানে তুমি কী করছ? বাজার হবে না আজ? এই সাতসকালে দাঁতের কোণ খুঁটলেই হবে? কত দেরি হয়ে যাবে বুঝতে পারছ না…

     নরহরি দলা পাকিয়ে থুতু ফেলে। ঢোক গেলে। ভাবছে দুর্মূল্যের বাজারে কথাটা সে কি করে বলবে? কথাটা বললেই প্রমীলা ক্ষেপে আগুন হয়ে যাবে। গতকাল শনিবার ছিল। অফিসে হাফ্-ডে। ফেরার পথে মাংস কিনে এনেছিল। খোকন অনেকদিন মাংস খায় না বলে। ছেলেটার এই বয়সে অনেক কিছুই খাওয়া উচিত। কিন্তু যা রোজগার, মন চাইলেও সাধ্যে কুলিয়ে ওঠে না। তাছাড়া মাংসের যা দাম। পরপর দু’দিন মাংস খেলে দরিদ্রের বিবেক যে ফোঁস করে উঠবে।

     প্রমীলা বাজারের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়াল। নরহরি বলল,

     তুমি কিন্তু গতকাল সুন্দর মাংস রান্না করেছিলে।

     একটু শক্ত ছিল না গো? মাংসটা বোধহয় কচি পাঁঠার ছিল না।

     না, ভালোই তো সেদ্ধ হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, এমন সুন্দর গন্ধের যাদু ছিল ভাবাই যায় না। এখনও হাতের তালু থেকে গন্ধ শুকোয়নি। নরহরি হাত থেকে সাধ্য মতন গন্ধ শুঁকে নিল।

     স্বামীর এই আদিখ্যেতা দেখে প্রমীলা অবাক হয়ে গেল। বেশ মজাও পেল, বলল,

     তাহলে বলো, আমার রান্নায় ম্যাজিক আছে?

     নরহরি খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল,

     নিশ্চয়ই। তোমার হাতে এত সুন্দর মাংস রান্না অনেকদিন খাইনি। তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো?

     বলো।

     আগে কথা দাও, তাহলে বলব।

     নরহরির কথা ঠোঁটে এসেও আটকে গেল। সম্পূর্ণ সাহস সে পেল না। একটু মনে মনে ভাবল, কি করে বলি, বিবাহিত জীবনে একদিনের জন্যও যে তোমার মন ভেজাতে পারিনি। দুঃখ হয়। হয়তো আমারই নিজের অক্ষমতা। একটা চাপা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরল। তবুও এক নিঃশ্বাসে যতটা সম্ভব সাহসকে সঞ্চয় করে বলল,

     তুমি যদি অনুমতি দাও, তাহলে আজও মাংস নিয়ে আসি।

     বলো কি গো? আজকেও? প্রমীলা ফোঁস করে ওঠে। খোকনের মাস্টারকে এখনও মাইনে দেওয়া হয়নি। মুদির দোকান থেকে নিমাই এসেছিল। টাকা দেওয়া হয়নি। দুধওয়ালা পর্যন্ত টাকা পায়নি। লাইটের বিল জমা দেওয়া হয়নি। অথচ এ মাসটা তো শেষ হয়ে গেল। কত কিছু বাকি পড়ে গেল। মাস শেষ হতে আর মাত্র ছ-সাতদিন বাকি। হাতে মাত্র একশোটা টাকা আছে। কি বে-আক্কেল মানুষ গো তুমি! এই নাও ব্যাগ! জ্যান্ত পোনা মাছ আনবে। পাঁচ-ছ টাকার মধ্যে। দাঁড়িয়ে রইলে কেন? দেরী কোরো না।

     নরহরি চুপসে গেল। বাজারের ব্যাগটা হাতে নিল। কিন্তু ঘরের ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল। টেবিলের কাছে এসে হাত ঘড়িতে চাবির দম দিতে-দিতে সকালের তাজা খবেরের কাগজের দিকে তাকিয়ে পনেরো বছর আগের একটি ভুলের কথা ভাবতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মাসের মাইনে হাতে পেয়ে গেলে সে সবটাই প্রমীলার হাতে তুলে দেয়। এমনকি প্রতিদিন অফিস যাওয়ার বাসের ভাড়া এবং সিগারেট বিড়ির নেশার পয়সা পর্যন্ত প্রমীলার কাছে না চাইলে পাওয়া যায় না। স্ত্রীর হাতে, সমস্ত টাকা দিয়ে দিলে, নিজের ইচ্ছেটাও পরাধীন হয়ে যায়। ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ বলে কিছু থাকে না। বিবাহিত জীবনটা নরহরির ছক কষে চলতে হয়েছে। একটু অন্যরকমভাবে বেঁচে থাকার কথা ভাবলেই সিগারেট অথবা বিড়ির নেশাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। নরহরি একটা বিড়ি দু আঙুলের ফাঁকে আটকে কানের কাছে রগড়ালো তারপর ঠোঁটে গুঁজে, ধরাল। বিড়ির ধোয়াটা বিস্বাদ লাগছে। মজাটাই যেন মজে গেছে।

     প্রমীলা বলল- এখনই তো বাজারের দিকেই যাবে। এখন বিড়ি ধরানোর কি হল? ঘরের আগুন নিয়ে বাইরে যাবে না। অনেকদিন লক্ষ্য করছি অফিস থেকে ফেরার সময় তুমি সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকছো। বাইরের আগুন নিয়েও ঘরে ঢুকবে না।

     নরহরি প্রমীলার এইসব সংস্কারের কোনই দাম দেয় না। যেমন, বিড়াল রাস্তা পার হলে যাওয়া-আসার সময় থুতু ছিটিয়ে আঙুল দিয়ে ক্রশ মার্ক করতে হয়, সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ জ্বালালে বিছানায় শুয়ে থাকতে নেই, বাড়ির বাস্তু সাপ মারতে নেই, ভাত খাওয়ার সময় দলা পাকিয়ে রাখতে নেই, অন্তত বাবা-মা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা যদি বেঁচে থাকে। আসলে প্রমীলার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কিছু ঘটুক নরহরি তা চায় না। তবুও সিগারেটের ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলে অভ্যাসের ভুলে। প্রমীলার নরহরির এই সামান্য শখ, নেশাটুকুও পছন্দ নয়।

     প্রমীলা বলে, প্রায়ই বলে- সিগারেট বিড়ি খেওনা, ওতে পয়সা পোড়ে। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। ওই আগুন ধোঁয়ার নেশাটা ছেড়ে দাও। না ছাড়লে, একদিন ভীষণ অশান্তি হবে। যেদিকে দুই চোখের দৃষ্টি যাবে, চলে যাব। যদি তোমার ক্যান্সার হয়। খোকনের দায়িত্ব, ওকে মানুষ করতে হবে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কোথায় দাঁড়াব? সিগারেট বিড়ির নেশাতে হার্টের ক্ষতি হয়। এটা কি ভেবেছ?

     নরহরি জানে প্রমীলা কোনদিনই চলে যাবে না। সংসারটাকে সে রোজকার আলো বাতাসের মতন ভালবাসে। নরহরিও কিছুতেই নেশা ছাড়বে না। প্রমীলা কি বুঝতে পারে না, প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু শৌখিন অবলম্বনের প্রয়োজন হয়? নরহরি মনে করে, অভাব-অনটন-টানাটানির সংসারে ধূমপান তার কাছে শৌখিন নেশার মতন। অন্য কোন বাইরের নেশা তার নেই। গান শোনার অভ্যাসও তার নেই। নেই বিদেশী সুগন্ধি সাবান সংগ্রহের অথবা ফুলের বাগানের নেশা। ঘুম থেকে ওঠা, নাওয়া-খাওয়া, অফিসে যাওয়া। ছুটির দিনটা প্রত্যেক দিনের মতন না হলেও প্রায় সব ছুটির দিন একই রকম ভাবে কেটে যায় নরহরির।

     নরহরি চৌকাঠ পেরিয়ে, বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠোনটা পেরিয়েই গেছিল প্রায়।

     প্রমীলা পিছন থেকে ডাকে- শুনতে পারছ না? কী হল? শুনে যাও। রসূন আনবে, পেঁয়াজও আনবে। আদা যেন বাদ না যায়। অল্প আছে, কুলোবে না। আর পাঁচশো গ্রামের মতো চন্দ্রমুখী আলু। টক দই। মশলা আনতে হবে না, ঘরে আছে।

     নরহরি অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।

     যেন চকিতে দশফুট লাফাতে পারবে এমন অবস্থা। এক অভিনব আনন্দে তার মন ভরে যায়। সচরাচর এমন হয় না। প্রমীলার মন কিন্তু সহজে গলে যায় না। নরহরি বুঝতে পারল, বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রমীলার জেদি মনোভাবটাও দুর্বল হয়ে গেছে।

     আসলে কিন্তু তা নয়। নরহরির বিষণ্ণ মুখটাই প্রমীলাকে নাড়া দিয়েছিল। প্রমীলার মনটাও হঠাৎ যেন ভিজে গেল। সংসারের জন্য মানুষটা তার শখ-আহ্লাদ সব কিছু বিসর্জন দিয়েছে। পরপর দুটো দিন মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হতেই পারে। সে ইচ্ছের কোনও দোষ নেই।

     প্রমীলা মুচকি মুচকি হাসছিল। নরহরি আলমারির চাবি চাইল। গোটা একশো টাকাই লাগবে। প্রমীলা বালিশের তলা থেকে চাপা দেওয়া চাবির গোছা নরহরির চোখের সামনে মেলে ধরল। চাবির গোছা তখন ডানদিক থেকে বাঁদিকে বেশ দুলে যাচ্ছিল। নরহরির চোখ ও মুখ খুশিতে দুলতে থাকে।

     প্রমীলা বলে- ওই একশো টাকাটা আলাদা করে রেখেছিলাম।

     নরহরি কথাটা যেন শুনতে পেল না।

ক্রমশ প্রকাশ্য...
বাসব দাশগুপ্ত – “ গ্রামে, আশ্বিন মাসে ”
শুভংকর গুহ – “ মানুষের মাংস ” ২
Close My Cart
Close Wishlist

Close
Navigation
Categories

Add address

India