স্যাটায়ার
আমাদের ছিল লেবুতলা, ছাইয়ের গাদা, কলেজ পুকুর, টম প্যারী টাওয়ার, কবুতর শালিখ মেনী হুলো চড়াই কাক এমন কী চিল শকুন। কিন্তু ডাস্টবিন ছিল না।
প্রথম ডাস্টবিন অফিসে দেখেছি যেন। রাজমহল রোডের ওপর ব্রিটিশ ছাদের একতলা ভূমি সংস্কার অফিস। বড়দার অফিস। সেখানে কাগজ ফেলার বাস্কেট দেখেছি।
বাড়িতে ডাস্টবিন ছিল না কারণ কোনও কিছুই বাড়তি নয়— সবটাই কিছু না কিছু কাজে লেগে যায়। তরকারির খোসা গরুছাগল খায় নয় মাটিতে মিশে উর্বরতা বাড়ায়। মাছ মাংসের টুকরোর জন্য তো বিরাট পার্টি লাইনে আছে। বিড়াল কুকুর চিল এমন কী লেবু গাছও পর্যন্ত। ঝেঁপে ফল আসার জন্য গাছের গোড়ায় গোল করে খাড়ি কেটে কুঁচো মাছের পথ্যি দিতে হয়। সবুজ ঘোমটার ফাঁক দিয়ে গাছ চেয়ে থাকে কুঁচো মাছের দিকে। খাবার পচা বা নষ্ট হবার কোনও চান্স নেই। মা ষষ্ঠীর কৃপায় সব বাড়িই জমজমাট। বরং সবার পাতে খাবার দেবার জন্য গিন্নিদের নানারকম ম্যানেজমেন্ট পলিসি থাকে। এমবিএ পাশ না করেও তারা নিখুঁত পরিচালনা পারে। একটু নমুনা দিই কবিতায়—
‘চারটি ডিম ষোলোজন খাবে
সুতো দিয়ে নিপুণভাবে কীভাবে ভাগ ভাবো।
এক সকালে কলাই থোড় মোচা
নটে শাক— উনুন একটাই।
ঘুঁটে খটখটে হলেও গুল কাঁচা।
আঠারো জনকে খাইয়ে চারজন
হেঁসেল যখন খাব খাব ভাবছে
ঠিক তখনই আবার সাড়ে পাঁচজন
অতিথি নারায়ণ— এখন?
দীপুর বই তাপু পড়েছে তাপুর বই
বুড়ো, বুড়োর বই লতু
কাঁথাও আলাদা লাগেনি ওদের— মাস্টার প্ল্যানিং?
দু দুটো আইবুড়ো ননদ ডিঙিয়ে কত সাবধানে
তাদের দাদার পাশে শোওয়া
টিন ছাদ। জবজবে ঘাম।
ঘামকে নদী বানানোর জন্য কোন রূপটান— ভাবো!’
এ হেন যাপনে কোনও গোদরেজ বা স্টিল আলমারি নেই। কাঁচ দেওয়া কাঠের আলমারি, সিন্দাবাদের সিন্দুকের মতো কাঠের বাক্স আর মায়ের একটা ঢাউস ট্রাঙ্ক— এই তো বিষয় আশয়। বইপত্র? ওই যেমন কবিতায় দীপুর বই তাপু পড়েছে, তাপুর বই বুড়ো … । আমি আর ছোড়দি প্রায় বছর সাতেকের ছোটো বড়— তাই আমি বরাবর নতুন বই। চার দিস্তা কাগজ দিয়ে বাঁধানো, ছাপা নীল কাগজের মলাট দেওয়া খাতা আর বড়দা, মেজদার শেষ হয়ে যাওয়া বাতিল শর্টহ্যান্ড খাতায় অঙ্ক প্র্যাকটিস। জমানো প্যাকেট প্লাস্টিক মোড়ক এসব কোথাও কিছু নেই। ছোড়দা শৌখিন। বইয়ের শখ। সেই ছয়ের দশকেই দেশ নেয়। খুব যত্ন করে বই পত্র রাখে। প্যাকেট কোথায়? থলে করে বাজার আসে। চটের থলে আর শক্ত চাদর, প্যান্ট কেটে কাপড়ের ব্যাগ। ভূষণদার মুদিখানার দোকান আর শান্তি বেকারীর মালপত্র কাগজের ঠোঙাতেই আসে। কাগজের ঠোঙা আবর্জনা নয়, উনুন ধরানোর কাজে দিব্যি লাগে। পেয়ারা, নিম ডাল, মাঙ্কি ব্যান্ডের দাঁতের মাজনের পাশাপাশি, ছাই দিয়ে বাসন মাজা। দাঁত মাজা। ছাইয়ের গাদায় নেড়িরা থাকলেও, আমাদের পোষ্য প্যারী টাওয়ার কেউই ছাইয়ের গাদায় যেত না। তারা বড় বাবু।
পাকা বাড়ির বারান্দার সিলিং-এ চাটাই দিয়ে পায়রা ঘর। খুবই নোংরা করত বারান্দা। তো তাদের বাহ্যও অমূল্য। ফেলা যাবে না। গাছের সার হবে। শুধু আমাদের বাড়ির জোগান দিয়েই তার প্রয়োজন মিটবে তা নয়, পাশের দত্ত বাড়ির সোনাদা (অনিক দত্ত— প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী)-ও নিয়ে যাবেন সে বর্জ্য— খুব ভালো গোলাপের সার।
আটের দশকে নতুন সংসারে যে যে বাড়িতে থাকলাম— প্রথমে ভাড়া বাড়ি, পরে নিজের বাড়ি— দুই বাড়ির পাশেই বড় পুকুর, ফাঁকা মাঠ, গর্ত, খানাখন্দ। ঘরে প্লাস্টিকের ছোট পাত্র, বিন বা ডাস্টবিন ঢোকেনি। কিন্তু অন্যরকম বর্জ্যর একটা বাতিল পর্ব তো শুরু হয়েছে। সাতের দশকে যখন আমাদের কৈশোর বেলা থেকে যৌবনের উত্তরণ পর্ব, অদৃশ্য ডাস্টবিনে দিচ্ছি অনেক হাবিজাবি মথিলিখিত সুসমাচার। নাটক, আবৃত্তি, ছোট পত্রিকা— এসব নিয়ে অন্য এক জগৎ। টিউশ্যানি করি, সেলফ হেলপের ট্রেনিং-এ টাইপ শিখি, লেখা পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে বার্লোর প্রাইমারিতে চাকরিও পেয়ে গেলাম। আরো পড়বো। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। বি.এ পাশ করেই বিয়ের পিড়িতে বসার বস্তাপচা সিলেবাস ফেলে দিয়েছি ডাস্টবিনে। অনার্সে, আমাদের ব্যাচে আমি একা মেয়ে— বাকী চারজন ছেলে। মেয়েদের শুধু মেয়ে বন্ধু এই ধারণাটাই পাল্টে যাচ্ছে। বাড়িতে সবার ছোটো হবার দরুণ বাবা, দাদাদের বন্ধুদের প্রচুর আস্কারা পাই। নাটকের লোকজন আর সাহিত্য পত্রিকা— এসব নিয়ে চেনা জানা পরিসর নেহাৎ ছোটো ছিল না। পুব বাংলা থেকে আসা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার আমরা। চাকুরীজীবী। কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হলেও কালী শিব সবাই আছেন কিন্তু খুব কঠিন নিয়ম কানুন নেই। সববারেই আমিষ। তাবিজ, জ্যোতিষের কোনও এনট্রান্স নেই। বাড়িতে ব্রত পুজো পাঠের দৈনন্দিকতা। কিন্তু সাতের দশকের সাম্যবাদী ভাবনা চিন্তার স্রোতে সে সব আমার মাথা থেকে উবে গেল।
টুকটাক লিখছি। সিনেমা-নাটক ভালোবাসি কিন্তু ভালো নাটক, সিনেমা মফঃস্বল শহরে সব সময় মেলে না। বইয়ের ডানায় ভর করে ওড়া যায় ভালো, বইটাকে আঁকড়ে ধরি। যা পাই তাই পড়ে ফেলার একটা ঝোঁক ছিল। আর পড়তে পড়তেই ফেলে দিতে শিখি। মাথার ভেতর একটা ভাঁড়ার আর একটা বীন। হাল্কা মুচমুচে স্ন্যাক্স ভালোই লাগে, কিন্তু বেশি দিন নয়। বাস্তবের রগরগে ঘটনার ছয়লাপ পড়তে পড়তে মনে হয় এর চেয়ে ইতিহাস পাঠই ভালো। অমল, অপুর পাশাপাশি কঙ্কাবতী টানে। ইভান ইলিচ আর লাঞ্ছিত নিপীড়িত বুড়োকে ভালো লেগে যায় খুব। মেঘনাদ টানে এমনকী দুর্যোধনও।
সাতের দশক মুক্তির দশক। জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহতদের মুক্তি হবে— সাম্যবাদের পথেই হবে— এই সব স্বপ্ন মোহ আকাশে বাতাসে। বিপ্লব এসে গেছে। শুধু নকশাল বাড়ি নয়— গোপীবল্লভপুর মেদিনীপুর থেকে সারা দেশ জুড়ে। বিপ্লব এসেছে কী করে বোঝা যায়? অনীক চট্টোপাধ্যায়রা বোঝায়—
‘— সবখানেই বিপ্লব হবার সময় হয়েছে, কী করে বুঝব অনীকদা? এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন— ভাত রান্নার সময় কি আর সব চাল আলাদা আলাদা করে টিপে দেখতে হয়? একটা চাল টিপে দেখলেই বোঝা যায় হাঁড়ির ভাত হয়েছে কিনা!
এই আলোচনায় অনীকদা ভাত রাঁধতে জানে দেখে জবার আনন্দ হয়। যদিও একটা মানুষকে টিপে হাজার মানুষের নাড়ি বোঝার ব্যাপারটা জবা ঠিক বোঝেনি’। (চিরকুট, পৃ. ২৮)
তবু সাতের দশক মুক্তির দশক হবে এই স্বপ্ন। নকশাল বাড়ি আন্দোলনে পাড়ার দুজন শহীদ হলেন। বহরমপুর জেলে ১৯৭১-এর ২৪ ফেব্রুয়ারিতে নৃপেন হালদার (বাবলু) পরে বন্দুক ছিনতাই করতে গিয়ে নকশাল নেতা সুদীপ্ত মৈত্র, বিচ্চুদা। মৃত বলে ঘোষিত হয়েও ফিরে এসেছে পিন্টু (মৃদুল সরকার)। বহরমপুর জেলে পুলিশী অত্যাচারে ধুঁকছে। পলিটেকনিক ডিপ্লোমা অর্দ্ধেক করে জেলে গিয়েছিল, সেটা কমপ্লিট করতে সে মরীয়া। ‘রাজনীতি করব না’ মুচলেকা দিতে হয়েছে, তার বিবেক দংশন। কিম্ভূত কিমাকার প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা। ‘ডাউন টু আর্থ’ হতে গিয়ে তেঁতুলতলার নেশার ঠেক। প্রেমে পড়েছি তার। পঠন পাঠন পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্বে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছি। প্রেমের হড়কা বান। সবার বারন বাঁধা উপেক্ষা করে এক সাথে চলার জেদ। নকশাল করা ছেলে একরকম ক্রিমিনাল। সমাজ পরিবারের চূড়ান্ত আপত্তি সেই পথ চলায়। ফেলে দে। ফেলে দে। হাতের লেখা ভালো বলে পোস্টার লিখেছিলি যেমন। পাড়া ভর্তি পুলিশের চর। বলেছিলাম, ফেলে দে ফেলে দে। হয় দুমড়ে মুচড়ে নয় পুড়িয়ে। তেমন ভাবে ফেলে দে নকশাল প্রেমিককে। ভাইকে। দাদাকে। সাতের দশক মুক্তির দশক। বিক্ষোভ। বিদ্রোহ। উত্তাল। ছিন্ন পলাশের মতো লাশ। সারা দেশটা যেন ভাগাড়। ডাস্টবিন। এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।
ক্রমশ প্রকাশ্য...