তৃপ্তি সান্ত্রা – “ সাদাকালো অ্যালবাম দিন ” ১

বিভাগঃ মুক্তগদ্য

১৬ আগস্ট, ২০১৭ … বিবাহের জন্মদিনে আমার আর পিন্টুর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে রিনি। ক্যাপশনঃ ৩৮ বছরের সাদাকালো album দিন …

ওমা! কত লাইক আর কমেন্ট! কত হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, অক্ষর আশ্রমের গুরুভাই গুরুবোন, আমার তিরিশ চল্লিশ বছর আগের ছাত্রী … ঝেপে নেমে এলো কত স্মৃতি!

কালো কুলো বেঁটে চেহারারও কত প্রশংসা! কেউ বল্লেন মিষ্টি, কেউ বল্লেন সন্ধ্যা রায়, কেউ শর্মিলা-সৌমিত্র, কেউ নুতন। পি.সি. – ফটো কার্টিসি কেউ জানতে চাননি। ছবির এতো প্রশংসা তো ছবিটা তোলার দক্ষতার জন্য। সেলফির যুগের ছেলেমেয়েরা পুরনো দিনের ছবি তোলার উত্তেজনা, স্টুডিও ফটোগ্রাফারের জাদুবক্স আর অনন্ত পোজ দেওয়ার ধৈয্য সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারনাই করতে পারবেন না। ছবি দেখে আমার কৈশোরের বন্ধু ডাক্তার গৌতম কুণ্ডু লিখেছেন – ছবিগুলো সাদাকালো কিন্তু আমাদের দিনগুলো ছিল রঙিন, এখন ছবি রঙিন কিন্তু …??? (সময় বলবে) …

এমন নয় যে ৩৮ বছর পর আমরা প্রবীণ হয়েছি তাই রঙ খুঁজে পাইনা। শিবেশ দাস লিখেছেন ‘সেই দুরন্ত সময় … আর সেই স্বপ্নেরা …’। সাতের দশক, আমাদের কৈশোর যৌবনের সন্ধিক্ষণ। সারা বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা, শোষণ দমন পীড়ন যুদ্ধ আন্দোলন, ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে নিষেধের বেড়াজাল, প্রাচীর।

আমাদের স্বপ্ন, আমাদের সমাজ পাল্টানোর অসুখ, আমাদের বেঁধে বেঁধে থাকার অক্ষর প্রয়াস নিয়ে এখনও সাদা কালো পৃথিবী … বিশ্বায়নের পদাঘাতে মুছে যায়নি সেই পৃথিবীর আলোছায়া জগৎ। মাদার গাছের তলায় আঁধার হবার মায়া দিন, জাদু-লণ্ঠন আঁকড়ে সেই দিনের স্রোতে ভাসা।

খুব উপকরণ ছিল না আমাদের কারো। শপিং ধামাকা নেই, সেলিব্রেশন নেই, আশিরনখর একান্ত গভীর গোপন দাম্পত্য বিছানা অব্দি ফটো সেশনের উন্মাদ বিকৃতি নেই। স্লেট লিখি মুছে ফেলি আবার লিখি। সঞ্চয় মাথায়, হৃদয়ে। ছোপছোপ কাটাকুটি সেলুলয়েড আমাদের হৃদয়ে।

একটা দুটো ফটোগ্রাফি বিলাস থাকে তবু। প্রয়োজন থাকে। জন্ম মৃত্যু বিবাহ … ধরে রাখে মেঘুদা বা অনুপদার ক্যামেরা। আমাদের বর-বউ ছবির ফটো সৌজন্যঃ অজন্তা স্টুডিও, মকদমপুর, মালদহ। ফটোগ্রাফারঃ অনুপ সিংহ।

সাতের দশকে আমার ছোড়দা আলফা ক্যামেরা কিনেছিলেন। মাথা কালো কাপড়ে না ঢেকে সে ক্যামেরায় দিব্যি ফটো তোলা যায়। ছোড়দার শৌখিনতায় অনেক দুর্লভ ছবি আছে আমাদের। বাবা-মাকে নিয়ে আমাদের আট ভাইবোনের বউ বর আর ছেলে মেয়ে নিয়ে বিরাট ক্যানভাস। ১৯৭১ সালের বন্যার দুর্লভ সব ছবি।

কিন্তু ছোড়দার ক্যামেরা কেনার আগের ছবিগুলো কারা তুলেছিলেন? আমাদের দোতলার ছাদে মেজদার বিয়ের পর তোলা গ্রুপ ফটো? আরো আগে বড়দির বিয়ের ছবি, আমার চেয়ারে বসে বইপড়া ছবি, মায়ের কোলে ছবি, দাদার মেয়ে মঙ্গলাকে জাপ্টে কোলে নিয়ে পিসি ভাইঝি ছবি? ফুলশয্যায় মেজদা মেজবৌদির একান্ত ছবিটি মেজদার কলকাতার বন্ধু দীপঙ্কর ঘোষাল তুলেছিলেন, মনে আছে। কিন্তু তারও অনেক আগে, আমার ছোড়দির ফ্রক পরা ছবি আর বোট নেক ব্লাউজ পরা, থুতনিতে বিউটি স্পট আঁকা, মেজদি ফাল্গুনীর সাদা কালো ছবি? তুলসীতলায় বাবার মৃতদেহ ঘিরে শোকদগ্ধ মায়ের পাশে আমাদের অসহায় মুখ … কে তুলেছিলেন?

ক্যামেরাম্যান মেঘুদা। ক্যামেরাম্যান সুধীর দাস। কালো ক্যামেরায় মাথা ঢাকা ক্যামেরাম্যান, আর চেয়ারে বেঞ্চে বা মাটিতে বসা ভালো ছবি তোলার জন্য মরীয়া পাথর থেকে পাথর হয়ে যাওয়া আমরা। ‘উঁহু-উঁহু হচ্ছে না, হচ্ছে না, মাথা সোজা কর। আপনি নড়ে গেছেন। মামীমা হাত দুটো সামনে ছড়িয়ে বসুন …’

এতদিন পরও ছবি তোলা নিয়ে নটখট চঞ্চল চপল আমাদের, আমাদের দাদা-দিদি-বৌদিদের হইচই শুনতে পাচ্ছি। ছোড়দি তো ক্যারিকেচার করতে ওস্তাদ, সব ঠিকঠাক করে যেমনি ক্যামেরাম্যান পেছন ফিরছেন, সে একটি ভঙ্গি দিল। আবার হি হি। বড়দের ধমক। ক্যামেরাম্যানের জরুরি ঘোষণাঃ আমার পিরোজপুরে ডাক আছে। এতো সময় নিলে কিন্তু পারব না … সুতরাং এবার সিরিয়াস। স্পীকটি নট। ঘুলঘুলি পায়রার একটু বকবকম – ওকে ক্যামেরা করা যাবে না? বাজে বকিস না খুকু। একদম মুখ বন্ধ করে ক্যামেরার দিকে তাকা। মুখ বন্ধ করে কতক্ষণ, ক্যামেরা কাকু সেই পেছনে গেলেন তো গেলেন-ই। এক সেকেন্ডও ঠিক থাকে না যারা, তারা অতক্ষণ ধরে চুপ করে থাকতে পারে নাকি! সোজা তাকাতে তাকাতে মাথা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে আর সেই বাঁকানো মাথাটি ভঙ্গি হয়ে গেল, আজ অব্দি। চিরদিনের।

ছয়ের দশকের মাঝামাঝি বা সাতের দশক থেকে স্টুডিওর রমরমা। বিভিন্ন কাজে পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগে। কনে পছন্দের জন্য ফটো তুলতে হয়। ‘রূপ থাকলে ধরে দেব, না থাকলে গড়ে দেব’ এমন চমৎকার সব কথা আর রূপ ধরা বা গড়ার সেই ভঙ্গিটিও বড় আটপৌরে সুন্দর। বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুললে কুঁচিটা একটু ছড়িয়ে যায়, আঁচলটা বাঁ হাতের ওপর দিয়ে টেনে, ছড়ানো। চোখ ক্যামেরার দিকে। আমার নিজের পছন্দে বিয়ে, সুতরাং কনে পছন্দের ফটো তোলার প্রশ্ন নেই। তবে ছোড়দি থেকে তপু—  নানা জনের ফটো তোলার সাথী ছিলাম। ক্যামেরার সামনে পোজ দেওয়া ভঙ্গি, আর তারপর হাতে গরম ফটো পেয়ে খুশী, ভালোলাগা, বিরক্ত এবং আনন্দ—  বাঃ! কী চমৎকার লাগছে ছবিতে। একটু হাসি আনতে বলছিলেন ক্যামেরা, সেটা চমৎকার ধরেছেন কিন্তু! ছোড়দিতো মহাখুশী—  মোটেও মোটা লাগছেনা বল!

কনে দেখা ফটোগুলো পরে লক্ষ্য করে দেখেছি একইরকম ভঙ্গিতে তোলা। পেছনে তাজমহল, ফোয়ারা সে সব কিছু নেই। টেবিল, ফুলদানি আর স্বপ্নে দেখা রাজকন্যেটির স্মিত মুখ।

অজন্তা স্টুডিও বা দাস স্টুডিও-র এই পরিচিত ভঙ্গির পরিবর্তন এলো সাতের দশকের মাঝামাঝি। রাজমহল রোডে, তমালদার সাথী স্টুডিওতে। যেখানে তপুর নতুন আবিষ্কার তমালদা বা তমালদার নতুন আবিষ্কার তপু। কনের ছবি তোলার চিরায়ত ভঙ্গিটি পাল্টে গেল, সমর্পিত নিবেদন নয় একটু যেন লাস্যময়ী নায়িকা ভঙ্গি। কানে বড় গোগো রিং পরা, একটু ঘার কাত করে ক্লোজ-আপ—  অসামান্য উঠেছিল তপুর ছবি। পাঁচ-চার হাইট, কোমর অব্দি চুল, পানপাতা মুখ, অসম্ভব বুদ্ধিদৃপ্ত মায়াবী চোখ—  একটু বেশি রোগার জন্য জন্য প্রাণচঞ্চল মেধাবী তপুর ‘আমি তো রোগা—  আমি তো রোগা’ বলে একটা ঘ্যানঘ্যানানি ছিল। তো এই ছবির এফেক্ট এবং আমাদের হৈ হৈ উল্লাস, উৎসাহ আর কারো কারো ঈর্ষাজড়ানো মুগ্ধতা তপুকে আত্মবিশ্বাসী করে তুললো রাতারাতি। ছবি তোলার নেশায় পেল তাকে। মুঘল-ই-আজম কায়দায়, শাড়িটা ঘাগরার মতো কার্পেটে ছড়িয়ে বসেছে তপু, দীর্ঘ বেণী, নাকছাবি, হাসছে—  পুরনো ঘরানার এফেক্টে অসামান্য একটা ছবি। সাদা কালো। কপালে একটা লালটিপ এঁকে দেওয়া।

অজন্তা, চন্দনা, দাস স্টুডিওর পুরনো ঘরানার বাইরে, সাথী স্টুডিও-র এই এক্সপেরিমেন্ট চমৎকার।

Tripti Santra

শিল্পীঃ শান্তনু গাইন

ক্রমশ প্রকাশ্য...
শাশ্বতী নাথ – “ একক কবিতা ”
তৃপ্তি সান্ত্রা – “ সাদাকালো অ্যালবাম দিন ” ২
Close My Cart
Close Wishlist

Close
Navigation
Categories

Add address

India