তৃপ্তি সান্ত্রা – “ সাদাকালো অ্যালবাম দিন ” ২

“ সাদাকালো অ্যালবাম দিন ” ১

বাজারে তখন নতুন ক্যামেরা ন্যাশনাল 35 চলে এসেছে। সচ্ছল মধ্যবিত্তর আয়ত্তে সে জাদুবাক্স। তপুর ইঞ্জিনীয়ার বরের ইয়াশিকা ক্যামেরায় ফটো তোলার শখ আর দার্জিলিং-এ বাড়ি এবং চাকরি—  সুতরাং নিরন্তর ফটোসেশনে তপুর নিজেকে অনন্ত আবিষ্কার।

সিঙ্গল বাস্ট ছবিতে সাথী স্টুডিও বিপ্লব ঘটালেও, বিবাহ পরবর্তী যুগলবন্দী ছবি তোলায় অজন্তার ধারে কাছে কেউ ছিল না।

নতুন ক্যামেরা এসেছে কিন্তু তার কারিকুরি বাঙালি বাবুর তখনও তত আয়ত্তে নেই। বিয়ের ছবির দাওয়াত নিয়ে নতুন ক্যামেরা কেলোর কীর্তি করে ফেলছে। কুলো, আগুন আর খই-কে ঠিকঠাক আনতে গিয়ে বরকনের মাথা কাটা। ফুলশয্যার ঘনিষ্ঠ ছবির স্বাভাবিক এফেক্ট এফেক্ট আনতে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। না বাবা, বিয়ের পরে একটা হাসি হাসি মেড-ফর-ইচ-আদার ছবির জন্য, নতুন ক্যামেরা আর ক্যামেরা ম্যানের ঝক্কি নেবার কোনও মানে হয় না। ভরসা থাকুক পুরনো অজন্তায়। আমি-পিন্টু, কৃষ্ণা-প্রবীর, মন্টু-মনসিজ, বনানী-ত্রিদিব, শ্যামলী-স্বপনদা, জয়া-বিশ্বনাথ—  আমার সংগ্রহে থাকা ছবিগুলো দেখছিলাম। সাদা-কালো ছবি। সামান্য একটু ঘোমটা টানা। ক্যামেরার সামনে একটু অস্বস্তি—  যাকে লজ্জা বা ব্রীড়া বলে মনে হয়। যার যেটুকু খুঁত, কমতি বা বাড়তি সব মিটিয়ে দিয়ে চমৎকার এডিট। সাদা কালো ছবি আবৃত্তিযোগ্য কবিতার মতো উচ্চকিত নয়। নিমগ্ন হয়ে রূপসী বাংলা পাঠের আত্মমগ্নতা।

বিয়ের পর বর-বউ ছবি, বাচ্চা হবার পর ল্যাকপেকে ঘাড় নিয়ে তিন-চার-পাঁচ মাসের বাচ্চাকে বসিয়ে ছবি তোলার পর্ব। তমালদার তুলে দেওয়া বাবাইয়ের ছবি দেখতে অপূর্ব বলল, আমারও অমন একটা ছবি আছে। আর পাশে বাবা ধরে আছেন, যাতে আমি পড়ে না যাই। বাবাইয়ের ছবির পাশেও কেউ আছেন, অদৃশ্য। বাচ্চার আলাদা ছবি। ছেলে মেয়ে কোলে নিয়ে সুখী পরিবারের ছবি। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের স্মৃতিকে ধরে রাখার নানা প্রয়াস।

স্টুডিওতে আমাদের বেড়ে উঠার বিভিন্ন পর্বের ছবি দেখছিলাম। আমার আর মঙ্গলা, আমার দাদার মেয়ের ছবি। কৃষ্ণা, আমার বড়দির মেয়ের সঙ্গে ছবি। তখন আমাদের বিনোদন লছমী, রূপকথা, বিচিত্রায় সিনেমা। নিষাদে মোগলাই। আর অল্প বয়সের বন্ধুত্বের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য স্টুডিওতে কখনও ফটো তোলা।

ছোটো থেকে কত যে নাটক নাচগান করলাম—  তার একটাও ফটো নেই বঙ্গরঙ্গ মঞ্চ শতবর্ষে ‘অলীকবাবু’ আর ‘কৃপণের ধন’ নাটকের কুশীলবদের নিয়ে গ্রুপ ফটো ছিল, হারিয়ে ফেলেছি। পাড়ায় সরস্বতী পুজো হবে না, তো আপুদি ঝুনুদির সাথে সবাই মিলে হৈচৈ করে পুজো হল। পুজোর টিমের আমরা স্টুডিওতে গ্রুপ ফটো তুলেছিলাম। —  কী চমৎকার কৈশোরের যৌবনের সেই ছবি! বারো-চোদ্দ জন, মোটা রোগা, লম্বা বেঁটে, শাড়ি ফ্রক, চুড়িদার। প্যান্ট-গেঞ্জির একজনই—  শহরের জিনত আমন, আমাদের পাড়ার মলি। চেয়ারে বসিয়ে, দাঁড়িয়ে আমাদের দুরন্ত কোলাজ তৈরি করেছিল অজন্তা স্টুডিওর ক্যামেরা।

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাণীভবানী হস্টেল থেকে এক সকালে আমি, কলি, রীতা, রাণী যে নাচতে নাচতে গেলাম বালাসন নদীতে—  তার ছবি নেই। তবে আমাদের দোল খেলার ছবি আছে, শিবমন্দিরে তোলা। উৎসা, কলি, কাবেরীর সঙ্গে আমি, মীনাক্ষিদি আর রীতা। এ ওর কপালে আবির দিচ্ছি এমন একটা ছবি। ছবি তোলার জন্য ছবি তোলা, স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। কিন্তু একসঙ্গে ছিলাম, এত দিন বাদে সেই স্মৃতিটুকু খুব জিদ্দি। চাইলেই তুলে ফেলা যায় না।

এইভাবেই পিকনিকের বাজার করতে গিয়ে শিলিগুড়ির টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে আমাদের ইংরাজি ডিপার্টমেন্টের ছবি। দুই যুবতীর মাঝে, চাপে হাঁসফাঁস করছে প্রদোষ। গুরুগম্ভীর টেকো মাথার সরীফউদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র বিমানদা। ইংরাজির সোশাল পেপার গ্রুপে মাত্র চারজন নভেল নিয়ে ছিলাম—  আমি, রীতা মণ্ডল, কৃষ্ণা ঝা আর প্রভাত গুরুং। এই গ্রুপের ছবিও আছে। কিন্তু দুই গ্রুপ ফটোর বন্ধুরা সবাই নেই।

সরীফউদ্দিন আহমেদ, দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছিলেন। ঢোলা পাজামা, পাঞ্জাবি, টাক মাথার সরীফদা চিরদিনই মাঝবয়সী প্রচ্ছদ নিয়ে গুরুগম্ভীর দাদা হয়ে রয়ে গেলেন আমাদের কাছে। খুব সিরিয়াস। ঝড়ের গতিতে লেখেন। আমাদের কলেজ মেট এবং ভার্সিটি মেট তিনি। এম.এ-তে টপার হতে পারেন নই, কাছাড়ের কলেজে যোগ দেন। দীর্ঘদিনের চাকরি তবু সম্ভবতঃ আসামের চাকরি ছেড়ে আমায় ব্রেকেজ অব সার্ভিস হয়ে যায় এবং সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও প্রিন্সিপাল হতে পারেননি সরীফদা। ডিপ্রেশনে, মানসিক আঘাতে চুরমার হয়ে যান, মারাও গেলেন তাড়াতাড়ি।

সাতের দশকের শেষে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোমান্টিক জুটি বালুরঘাটের রীতা মণ্ডল, কাসিয়াং-এর প্রভাত গুরুং। রীতা চত্বর কাঁপানো সুন্দরী। প্রভাত কবি, গায়ক এবং রোমান্টিক প্রেমিক। পরে ওরা বিয়ে করে। কাসিয়াং-এ চাকরি পায় দুজনে। ষাট বছর বয়স হবার অনেক আগেই প্রভাত চলে গেছে। আমাদের চারজনের সাদা-কালো ছবিতে, তিন যুবতীর মাঝে অনিন্দ্য সুন্দর যুবকটির চোখে মুখে শরীরে কোথাও মৃত্যু ছায়া নেই। ঝিপঝিপ বৃষ্টিতে গিটার বাজিয়ে সে গাইছে ‘চ্যাংমা হো চ্যাংমা’ ঝলমলে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছি আমরা।

আরো আগে সত্তরের শুরুতে, যখন আমরা নবম শ্রেণী ও শাড়ি-বাড়ির অসংখ্য অসংখ্য বাধা নিষেধের মধ্যে একটি হল, ব্যাটাছেলের থেকে দূরে থাকা। তাদের সঙ্গে ছবি না তোলা। শুধু শুধু তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেই বা যাব কেন? হ্যাঁ, তুলবে না। ওই এক ছবি দিয়েই জীবন তছনছ করে দিতে পারে। ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। আর আমি নিজেই যদি ছবি তুলি। বিয়ে করতে চাই। কক্ষনো না। প্রেম আর বিয়ে এক নয়। প্রেম করলে লঘুগুরু জ্ঞান থাকে না।

তো প্রেম করলেই, ছবি তোলা যাবে, এমন নয়। ছবি তুলতে পয়সা লাগে। নারায়ণদা, কেয়াকে নিয়ে অজন্তা স্টুডিওতে ছবি তুললেন—  চাকরি করতেন বুঝি তখন! তো সেই ছবির জন্য কম কেলেঙ্কারি হল না!

ছবির কপিগুলো নিজের কাছে রেখে বারবার মুগ্ধ বিস্ময়ে তরুণ দৃপ্ত যুবকটিকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল কেয়া। বামুন বাড়ির মেয়ে, দাস ছেলের সঙ্গে ছবি তুলেছিল। পাশাপাশি বসা, চোখে মুখে পিরীতি আঠা, সে গেল, হাতের সঙ্গে হাত যে পাশাপাশি ছুঁয়ে গেছে। তো ভাঙ। ভাঙ। ভাঙ করার মতো কাট। কাট কাট। যুগল ছবিকে খণ্ড খণ্ড করে সিঙ্গল করা হল। নেগেটিভ কই? নেগেটিভ কই? অজন্তা তো নেগেটিভ দেয় না। দেয়না বললেই হবে, দিতে হবে!! দলবল নিয়ে প্রচুর বাওয়াল করে অজন্তার অনুপদার কাছ থেকে নেগেটিভ উদ্ধার করে আনলো কেয়ার ছোটো মামা। নারায়ণদার কাছে রাখা ছবিটার সন্ধান ছোটো মামা পাননি। খুবই চাপ, শাসন আর বাড়াবাড়িতে ছবির নায়ক নায়িকা, সময়ের আগেই বিয়ে করল। বাড়ি থেকে পালিয়ে।

কথা প্রিয়। তার চেয়েও প্রিয় লেখা চিঠি। সে তো ফুরোয় না, থেকে যায়, সব মিথ্যে শিহরণ নিয়ে। কায়া প্রিয়। তার চেয়েও প্রিয় ছায়া, ছায়া-ছবির মানুষ। হারিয়ে যাওয়া কৈশোর আর যৌবনের দু-একটা ছবি ঘিরে আমাদের মুগ্ধ শিহরণ। মেক-আপ করাচ্ছেন না। পেইন্টারের মতো! তুলি দিয়ে চোখ আঁকছেন না ভুরু আঁকছেন না ঠোঁট আঁকছেন না। ক্যামেরার পেছনে তাঁর তৃতীয় নয়ন তৈরি করছে প্রতিবিম্বর নতুন বয়ান। তখন ক্যামেরার দূরে । স্রষ্টার তৃতীয় নয়ন দূরে। সট্ সট্ করে ক্যামেরার মায়া-মুকুর সেলফি তোলার ভাবনা, কল্পনাতেও ছিল না। পোট্রেট আঁকার জন্য সময় দিতে হয় দীর্ঘ। রবি বর্মা আঁকছেন দময়ন্তী আর হাঁস। লেডী রাণুর পোট্রেটের জন্য যেন কটা সিটিং?

এইসব তুলি ইজেল মডেলের অলৌকিক জগৎ থেকে একটু মেড-ইজি স্টুডিওতে ক্যামেরার ফটোসেশন। বাড়িতে একটা ড্রেসিং টেবিল, ড্রয়ার দেওয়া, চমৎকার পেখমের মাঝে আয়না। সেখানে মুখ দেখে অন্ততঃ কুড়ি জন। নিজেকে আবিষ্কারের অত সুযোগ কোথায়। হ্যাঁ, আসল আয়না হচ্ছে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের চোখ। তাদের চোখেই নিজেদের আবিষ্কার—  কার মুখ পানপাতার মতো। কার দীঘি আঁখি। কে অপর্ণা ছাঁচ আর কে জীনত আমন।

আর দর্পণে শরৎশশী, বিম্বাবতী রূপদেখা যেন ঐ পোস্টকার্ড সাইজ ফটোগ্রাফে। মাথা একটু সোজা। মুখে একটু হাসি রাখো। না, হল না। আবার ক্যামেরা থেকে এগিয়ে এসে মাথা ঠিক করে দিলেন তিনি। অত জড়সড় কাঠ কাঠ ভাব কেন! ক্যামেরার সামনে নয়, ভাবো এমনি বসে আছি! প্রাণপণে নির্দেশ মেনে চলছি কুশীলব। কারণ তৈরি হচ্ছি আমরা। সেই ফুরিয়ে যাওয়া বিকেল, সিরসিরে বয়স, বেলোয়াড়ি কাচের মতো ভেঙে যাওয়া সুখের মুহূর্ত—  সব ধরে দেবেন তিনি, ক্যামেরার ওপারের চোখ।

সাদাকালো পৃথিবীর মায়া রাস্তা। বড়ো নদী। ফ্রিল দেওয়া ফ্রক। দুই বেণী আর এলো খোঁপার পাশে, ব্রীড়াময় কালো প্যান্ট, সাদা জামার ধীমান যুবকেরা। তাদের শরীর ঘিরে উদাসী হাওয়া আর ছায়াবীথি কদমের ঘনঘোর।

একটু প্রস্তুতি। গভীর মনোযোগ। ক্যামেরার পেছনে শিল্পী তৈরি করে দিলেন, বিলীয়মান কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার আগে, আমাদের সাদাকালো টলমলে জলছবি দিন …

Tripti Santra 2

শিল্পীঃ শান্তনু গাইন

 

সমাপ্ত
তৃপ্তি সান্ত্রা – “ সাদাকালো অ্যালবাম দিন ” ১
স্বাতী গুপ্ত – “ খুলে দাও লক গেট ”
Close My Cart
Close Wishlist
Recently Viewed Close

Close
Navigation
Categories

Add address

India