(২)
এ দলটার সুঙ্গি তা নাই নাই করি পাঁচ বছর হল জুতে গেছে। না কোনো দুঃখে কষ্টে সে ঘর ছাড়েনি। স্রেফ মন বসতোনি। ইছামতী নদীর ওপারে সংগ্রামপুরের ঘাট পেরিয়ে শিবহাটি গ্রামের জুনিয়ার হাইস্কুলটায় বাপের রাম ঠ্যাঙানির ভয়ে এইট কেলাস অব্দি ঘষটেছেও। কিন্তু যেই মাত্র নাইন ক্লাসে তাকে বসিরহাট পড়তে চালান করা হবে বলে বাড়িতে রব উঠলো তখনই কৃষ্ণের অন্তরাত্মা দমে বিদ্রোহ জানালো। না আর নয়। এক ভোর রাতে ক’টা জামাকাপড় আর ঠাকুমার লক্ষ্মীর ঘটখানা নে নিরুদ্দেশে পাড়ি জমালো কৃষ্ণ। বাপ-মায়ের বুক ফাটা হাহাকার একটুও কানে বাজেনি তার। বরং অনেক বেশি করে বেজেছিল রেল গাড়ির বাঁশী। আহা সে যেন ছিল সত্যিকারের কৃষ্ণ ঠাকুরের মুরলী। ঘুরতে ঘুরতে সে কেমনি করি বীরভূমের লাভপুরে এসি পৌঁছেছিল, সে বেত্তান্ত নিতান্তই সাদামাটা। সেখানে এক বহুরূপীর দলের সঙ্গে ভিড়ে গে পথে পথে ভিক্ষে করি বেড়াতো। নীল রঙ মাখিয়ে, মাথায় ময়ূরের পালক গুঁজি তাকে সত্য সত্যই কেষ্ট ঠাকুরের মতো দেখাতো। কিন্তু গাং-বিলের দেশের জলের পোকার মতো যে আজন্ম বড়ো হয়েছে, এপার ওপার দেখা যায় না যে নদীকে বুকে নে যে কিশোর হয়, তার কি কখনও ঐ রাঢ় দেশের টাড় অঞ্চলের রুক্ষ প্রকৃতি ভালো লাগে? এক বছরেই হাঁপিয়ে উঠেছিল মন। ইছামতী নদীটা শয়নে, জাগরণে তাকে ডাকতো। ঐ বহুরূপী দলের মাথা লোকটার স্বভাব চরিত্তিরও ভালো ছিল না। ফাঁক পেলেই কৃষ্ণের গায়ে হাত বোলাতো। কেমন জানি ঘিনঘিনে লাগতো তার। একবার সাঁইথিয়ার বাজারে নটবর সেজি ভিক্ষে করবার সময় বিশাখা খপ করি তার হাত ধরি বলে, ‘তুমি তো সত্যিকারের কেষ্টো ঠাকুর গো। ইদের সুঙ্গি কি মরতি আছো। আমাদের দলে যোগ দেবে চলো’। ব্যাস, ঐ বাজার থেকেই ভোঁকাট্টা কৃষ্ণ। বিশাখা তাকে শেয়ালদহে নে এনে বসিরহাটগামী ট্রেনে চাপালে, কৃষ্ণ বলে ফেলে, ‘ও বিশু তুই তো আমারে বাড়ি নে চললি’। বিশু হেসে বলে, ‘আমাদের কংসদার কারাগারখানা যে উদিকেই। কিন্তু আমাদের দলের নেয়ম যে যা পার্ট করে তারে সে নামে ডাকতি হয়। আমরা সঙ সাজি তাই আমাদের আসল পরিচয় কাউরে জানানো মানা আছে কংসদার। আমারে তুমি বিশাখা বলেই ডেকো’। ট্রেনের জানলা দে ভরা বর্ষার গাভীন মেঘগুলো চাতকের মতো দেখতি দেখতি কৃষ্ণ বেলিয়াঘাটা, হাড়োয়া, মালতীপুর ইষ্টীশানগুলো পার হতি লাগলো। রেল লাইনের দু’ধারে ধু ধু জলকরের টোমঘরের দিকে চে কৃষ্ণ ফস করি বলি ওঠে, ‘বিশাখা তোর কংসের কারাগারে ঢোকার আগে এট্টিবার বাড়ি যাব’। আকাশের স্লেট রঙের মেঘের ফাঁক দে উঁকি মেরে রোদের এক চিলতে হলুদ রংখানা মায়ের পরনের হলুদ রঙের ছাপার শাড়িটাকে বড়ো মনে পড়িয়ে দেয় কৃষ্ণের। বিশাখা বলেছিল, ‘তোরে যদি আসতি না দেয় আর তারা?’ ভুবনমোহন হাসি দিয়ে বলে কৃষ্ণ, ‘পালাবো’।
ঘরে ফেরা কৃষ্ণের মধুর হয়নি। গে শোনে মা ছ’মাস আগে কি এক অজানা জ্বরে মরে গেছে। ঠাকুমা নাতির থেকেও বিপত্নীক ছেলের মধ্যযৌবন থেকি বাকি জেবন কি করি চলবে তার চিন্তায় আকুল। কাল বছর কাটলেই ছাদনাতলায় ছেলেরে পাঠাবে এই তার সিদ্ধান্ত। পরের ভাই-বোন দুটি নিতান্তই বালক, বালিকা। অবোধ। তারা খানিক দূরে দাঁড়িয়ে খালি তাদের দাদাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এবার লুকোচুরি না রীতিমত মাছের ঝোল ভাত খেয়ে, ভাত ঘুম দে বাবাকে প্রণাম করে কৃষ্ণ বিদায় নেয়। ঠাকুমা শুধু বিনবিন করি কেঁদে ছিল প্রণাম নেওয়ার সময়। বলেছিল, ‘মাঝে মাঝে আসিস। কবে আছি কবে নেই’।
ইছামতীর ধারে বসি বসি সেসপ কথা বড়ো মনে পড়ে কৃষ্ণর। নদীর পারের তলতলে কাদামাটি ওপর তে’ চোখো মাছগুলো ভেসে উঠছে। ছোটছোট তেলি কাঁকড়াগুলো গুটিগুটি পায়ে দিকভোলার মতো হেঁটি চলিছে ইদিক-উদিক। এদিকে নাবালের জমিতে বড়ো বড়ো জলঘাসগুলো লকলক করছে। একটা বিষহীন জলঢোরা কাদার উপর দে সরসর করি নেমি জলে চলি গেল। কিছুক্ষণ জলের বুকে সাপ চলার আঁক দেখা যায়। কৃষ্ণেরও ইচ্ছা করে অমনিভাবে ইছামতীর জলে হারিয়ে যেতি। বড়ো জিরাকপুরের সরকারি জমিতে বলতি গেলি স্থায়ী আস্তানা গেঁড়ে নিয়েছে ‘কংসের কারাগার’। কত দূরদূর মুলুক থেকি এ দলের কুশিলবেরা যে ইখানে এসে ভীড়েছে তা চমকে দেওয়ার মতো সে সপ কাহিনী। কৃষ্ণের বাড়িই ধরতি গেলি সব থেকি কাছে। প্রায় ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বেস ফেলে, তবু এই পাঁচ বছরে আর মন টানেনি সেখানে যেতি। তবে মেঘের গর্ভ ফেটি হলুদ রঙের কলকে ফুলের মতো আলো আলো রোদটা উঠলেই মার সেই হলুদ রঙের ছাপার শাড়িটার কথা মনি পড়ি যায়। বিশাখা একদিন চুপি চুপি বলেছিল, ‘চ কেষ্টাদা তোর বাপের নোতুন বৌটাকে দেখি আসি’। কৃষ্ণ মুচকি হেসে উত্তর করে, ‘বৌটাও যদি হলুদ ছাপা শাড়ি পড়ি থাকে। তার চে এই ভালো’। বিশাখা কৃষ্ণের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতি না পেরি ভ্যাবলা মেরি তাকায়ে ছিল ড্যাবড্যাব করি। শুধু বিশাখা সখি কেন কংসের কারাগারের কেউই তার রকমসকম বোঝে না। তবে মানুষটা যে খাঁটী ভগবান কৃষ্ণের মতোই নির্ভেজাল তা এদ্দিনে সক্কলে বুঝে গেছে। পারতপক্ষে নেশাভাণ করে না। গ্রামের মেয়ে, বোউদের পেছনে মশার চাকের মতো পোঁ পোঁ করি বেড়ায় না। নিজের খেয়ালে থাকে। অভিনয়ের সময় ছাড়া রাধুটাকে তো কাছে ঘেঁষতি দেয় না। কংসও তাকে বিশ্বেস করে। গাঁয়ের বৌ-ঝিরা ছেলেপিলের পেট নামলি বা ভয় খেলি কৃষ্ণের কাছে নে আনে। বলে, ‘দেও দেখি বাবা মধুসূদন বাছার মাথায় হাত খানা ছুঁইয়ে’। সেই থেকিই বোধহয় কচি বাচ্চার গায়ের গন্ধ তাকে পাগলের মতো টানে। কলাটা, মূলোটা পাঁচ, দশ টাকা আয়ও হয় ভালো। তবে ওসব নে কৃষ্ণের মাথাব্যাথা নেই। সে আছে নিজেই নিজের রসে মজে। আর এখন তো লাট্টু তার দিন রাত গুলিয়ে দিয়েছে।
ক্রমশ প্রকাশ্য...