(২)
এবার এক অন্যধরনের ডাস্টবিনের কথা বলব। যে কোন কম্পিউটার খুললে মনিটারের পর্দায় আমরা রিসাইকেল বিন নামে একটি লোগো দেখতে পাই। একে বলে ই-ডাস্টবিন। আমাদের আমাদের অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলোকে আমরা এই ডাস্টবিনে পাঠিয়ে দিই, যাতে কম্পিউটার প্রোগ্রাম ফাইলের ভারে ক্লান্ত না হয়ে পড়ে। অবশ্য রিসাইকেল বিন ডাস্টবিনে পাঠানো ফাইলগুলো, যে গুলো ই-আবর্জনা তা আবার প্রয়োজনে ফিরিয়ে আনা যায়, যদি না সেগুলো চিরতরে ডিলিট করে দিই। অন্যদিকে যখন ইন্টারনেটের কোন মেল বক্সে যাই, সেখানে কম্পিউটারে আসা জাঙ্ক মেল ও ট্র্যাশমেলের দুটো ডাস্টবিন দেখা যায়। কম্পিউটারের পক্ষে দূষিত ফাইলগুলো এই ডাস্টবিন দুটো ধরে রাখে। তাদের মূল ই-মেল বক্সে আসতে দেয় না। অনেক সময় এই দুটো ডাস্টবিনে আটকে থাকা ফাইল আমরা আস্তাকুঁড় থেকে খুঁজে নিই এবং ফাইল খুলে প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন দেখে নিই। অনেক সময় কম্পিউটারের হার্ড-ডিস্ক যেসব সমস্যা তৈরি করে, বা কম্পিউটার প্রোগ্রামে গণ্ডগোল দেখা যায়। তার কারণ কম্পিউটারে জমা ঐ সব আবর্জনা – যাকে আমরা অনেক সময় ভাইরাস বলি। এই ভাইরাস বা আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য কুইকহিল বা অন্য কোন অ্যান্টি ভাইরাস প্রোগ্রাম লোড করি। এইসব প্রোগ্রাম ই-ডাস্টবিনের আবর্জনা দূর করে।
আমরা অনেকেই জানি না, কম্পিউটার যেমন মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে নানাভাবে সাহায্য করছে, মানব ও পশুপাখি, উদ্ভিদের জীবনে নানা বিপর্যয় ডেকে আনছে। আমাদের অজ্ঞাতসারেই ই-আবর্জনার বিষ আমাদের ডিজিটাল যুগকে বিষাক্ত করে তুলছে। ইলেক্ট্রনিক আবর্জনা পানীয় জলে শুধু বিষ ছড়াচ্ছে না, পৃথিবীর ইকো-সিস্টেমের ক্ষতি করছে। যার ফলশ্রুত পানীয় জলের ভাণ্ডার কমে আসছে, প্রাণী-উদ্ভিদ-জীবজগৎ তাদের গুণগত বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। কেননা সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ টন ই-আবর্জনা দিনে দিনে পৃথিবীটাকেই ডাস্টবিনে রূপান্তরিত করছে। বিষাক্ত পদার্থের ডাস্টবিন। একটা তথ্য বলছে শুধু ২০১২ সালেই পৃথিবীতে ১.৬ বিলিয়ন ( ১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি ) তৈরি হয়েছে। আর্সেনিক, সীসা, পলিব্রোমিনেটেড ফ্লেম রিটারডেন্টস-এর মতো নানা বিষাক্ত পদার্থ যেগুলিতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবছরই বাজারে এইসব ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের নতুন নতুন মডেল আসছে আর পুরোনো মডেল বাতিল হয়ে পৃথিবীকে আস্তাকুঁড়ে রূপান্তরিত করছে। বিশেষত গরিব তৃতীয় দুনিয়াকে, কেননা অর্থনীতিতে উন্নত ধনী দেশগুলি নিজেদের দেশের পরিবেশ আইন থেকে মুক্তি পেতে কম্পিউটার, সেলফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের কারখানা বা প্লান্ট তৃতীয় দুনিয়াতে স্থাপন করছে। পশ্চিমি উন্নত দুনিয়ার কাছে তৃতীয় দুনিয়া হল আস্তাকুঁড় বা ডাস্টবিন! ই-আবর্জনার বিষ সম্পর্কে উন্নত দুনিয়া সচেতন হলেও – আমরা না। পশ্চিমি দুনিয়ার নাগরিক সমাজের পরিবেশ সচেতনতা, পরিবেশ আন্দোলন থেকেই আমরা বুঝতে পারছি তৃতীয় বিশ্বের ডাস্টবিনে কি পরিমাণ ই-আবর্জনা জমছে। প্রতি বছরই ই-আবর্জনার স্তূপ বাড়ছে। ই-পণ্যের বিশ্বায়িত বাজার যত বাড়বে ই-আবর্জনাও বাড়বে এবং বিষবাষ্পে পৃথিবী ভরে উঠবে।
(৩)
যখন বিদ্যালয়ের কিশোর প্রতিবারে ষাণ্মাসিক বা বাৎসরিক পরীক্ষায় একটি রচনা আসার উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকতঃ বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ। বড় হয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি বিজ্ঞানের দুটি রূপই সমান শক্তিশালী। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞান যেমন আশীর্বাদ, অভিশাপও। পাথরযুগে আমরা পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতাম এখন আকাশচুম্বি হাইরাইজের গুহায়! এবার যে ডাস্টবিনের আবর্জনার কথা বলব সেটি একটি ভয়ঙ্কর ডাস্টবিনের আবর্জনা। সাদামাটা ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে নিউক্লিয়র-আবর্জনা বা পরমাণু-আবর্জনা। আকাশে, ভূ-গর্ভে বা সমুদ্রে পরমাণু বিস্ফোরণের পর যে তেজস্ক্রিয় বিকরণ ছড়িয়ে পড়ে তাকে আমরা বলি তেজস্ক্রিয় ধূলো ও ছাই। আকাশে যা পাইরোকিউমুলাস মেঘ তৈরি করে আর যে মেঘ থেকে কালো-বৃষ্টি মাটিতে নেমে আসে! এই মেঘ বা কালো-বৃষ্টি তেজস্ক্রিয় দূষণে জীবজগতকে সংক্রামিত করে ও তাদের ধীরে ধীরে মৃত্যু ডেকে আনে বা দেহে বিকৃতি ঘটায়। নদী ও সাগরের জলকে দূষিত করে। মাঠে মাঠে শস্যে বিষ প্রবেশ করে। আবহাওয়া ও জলই যদি দূষিত হয়ে যায় – মানুষ কি করে বাঁচবে? পরমাণু বোমার ব্জ্র নির্ঘোষের বৃষ্টি তো তেজস্ক্রিয়কণার বৃষ্টি। বর্তমানে পরমাণু বোমার তুলনায় হিরসিমায় ও নাগাসাকিতে যে দুটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল তারা খেলনা বোমা। আমরা রেডিয়েশন সংক্রামিত হলে আয়ু দ্রুত কমে আসে। ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, উর্বরতা শক্তি কমিয়ে দেয়, জেনেটিক মানচিত্রে বদল ঘটিয়ে দেয়। নারীগর্ভে থাকা শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মায়, বিশেষভাবে শিশুরা আক্রান্ত হয়। এই তেজস্ক্রিয় আবর্জনা ফেলার মতো অন্য যেসব ডাস্টবিন তৈরি হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। অনেকেই জানেন না পরমাণু বোমাগুলির নির্দিষ্ট আয়ু আছে, আয়ু কাল ফুরিয়ে গেলে সেগুলি মৃত বা শবদেহ, আমাদের এই গদ্যের ভাষায় আবর্জনা। এই আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন ভূ-গর্ভ বা সমুদ্র-গর্ভ। আকাশে বা বাতাসে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটালে সেই আবর্জনার ধুলো বা মেঘ শুধু গরিব তৃতীয় দুনিয়াকে গ্রাস করবে না, ধনী পশ্চিমি দুনিয়াকেও গ্রাস করবে, ফলে বিজ্ঞানীরা আজকাল স্থলে পরমাণু পরমাণু বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে জলে বা ভূগর্ভে ঘটান। সাম্প্রতিককালে মৃত পরমাণু বোমাগুলির অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয় বিকিরণের হাত থেকে বাঁচতে সেগুলিকে উপগ্রহের সাহায্যে মহাকাশে পাঠিয়ে দেবার কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থাৎ মানুষ মহাকাশকেও ডাস্টবিন বানাতে চাইছে। বলা যায় না, কোনদিন হয়ত শুনব মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর আবর্জনা ফেলার ধাবা হয়ে গেছে। পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত রকেটগুলি কৃত্রিম উপগ্রহ বোঝাই ই-আবর্জনা, পরমাণু-আবর্জনা সেখানে বয়ে নিয়ে যাবে।
সমাপ্ত