বিজয় দাস – ‘ইসমাইল কাদারের সাহিত্য ভাবনা ও ‘দ্যা জেনারল অব দি ডেড আর্মি’’

-640-0-5b4a013fd0ca8

“I’ve learned that fear limits you and your vision. It serves as blinders to what may be just a few steps down the road for you. The journey is valuable, but believing in your talents, your abilities, and your self-worth can empower you to walk down an even brighter path. Transforming fear into freedom – how great is that?”    – Soledad O’Brien

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপীয় একটি রাষ্ট্র। নিজস্ব সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অধিকারের লড়াই ক্রমাগত চালিয়ে গেছে প্রাচীন কাল থেকে। কখনও গ্রিক আধিপত্য, তো কখনও ইতালীয় প্রভাব। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জার্মানি। এবং স্বাধীনতা লাভের পরেও ফ্যাসিবাদি স্বৈরশাসন। আলবেনিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাই বারেবারেই বিদ্রোহের ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে ওঠে।

কবি ও লেখক ইসমাইল কাদারেও প্রায় সারা জীবন লড়াই করে গেছেন দেশের অভ্যন্তরীণ সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। তার লেখায় বারে বারে উঠে আসে আলবেনিয়ার সৌন্দর্য এবং প্রতিবাদ। তাই তিনি মানসিক ভাবেও আক্রান্ত হয়েছেন বহু বার। বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা প্যালেস অব ড্রিমস’-কে ব্যান করে দেওয়া হয়েছিল, দেশের বাইরে যাওয়া ও বই প্রকাশও সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর প্রতিবাদের ভাষা কখনও বন্ধ হয়নি। একের পর এক মহান সৃষ্টি বিশ্ব সাহিত্যকে উজ্জ্বল করেছে। মাতৃভূমির সৌন্দর্য, সংগ্রাম, হিংসা ও বিদ্রোহকে তিনি বিশ্বমানুষের সামনে তুলে ধরেছেন অসামান্য গদ্য ভাবনায়। তিনি লিখছেন, “The great universal literature has always had a tragic relation with freedom. The Greeks renounced absolute freedom and imposed order on chaotic mythology, like a tyrant.”

সাহিত্যে অবদান হিসেবে রয়েছে বিখ্যাত কিছু সৃষ্টি, দ্য ওয়েডিং (১৯৬৪), দ্য ক্যাসেল (১৯৭০), ক্রোনিকল ইন স্টোন (১৯৭১), ব্রোকেন এপ্রিল (১৯৮০) ও দ্য পিরামিড (১৯৯২) ইত্যাদি। পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে ওনার লেখা। ১৯৯২ সালে ‘পিক্স মন্ডিয়াল কিনো ডেল ডুকা’ পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে ‘ দ্য ম্যান বুকার’ পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে পান প্রিন্সেস অব অ্যাস্টুরিয়াস এ্যাওয়ার্ড। বেশ কয়েক বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছেন তিনি। এছাড়া আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন ইসমাইল কাদারে। লন্ডনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা তাকে গোগল, কাফকা ও অরওয়েলের সঙ্গে তুলনা করে। কবি, ঔপন্যাসিক, রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী ইসমাইল কাদারেকে নিজের স্বাধীনতার জন্য যথেষ্ট মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ‘Literature led me to freedom, not the other way round. উনি মনে করেন, “সত্যিকার কল্যাণ রাষ্ট্র আসলে একটি মায়া, এক স্বপ্নজাল কিংবা পারলৌকিক শান্তি স্থানের মত কাঙ্ক্ষিত- যা দেখতে হলে পার হতে হবে সেই একমুখী দরজা…”।

রাশিয়ার মস্কো থেকে প্রকাশিত হয় কাদারের প্রথম কবিতার বই ‘ড্রিমস’। কম্যুনিস্ট ও ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন এবং শোষণপীড়িত মানুষের যন্ত্রণার এক অনন্য রূপ ‘ড্রিমস’-এর কবিতা গুলি, যা সোজাসুজি পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। ‘UNESCO’ প্রকাশিত “Anthology of Modern Albanian Poetry” বইটিতে কাদারের কবিতা সম্পর্কে বলেছে, “Kadare’s poetry was less bombastic in form than earlier verse and it thus gained direct access to the hearts of the readers who saw in him the spirit of times and who appreciated the diversity of his themes.”

বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি জায়গায় বলেছিলেন, ওনার সমস্ত কবিতাগুলি যদি নষ্টও হয়ে যায় তবে ওনার গদ্য পড়লেই বোঝা যাবে সেগুলো একজন মহান কবির লেখা। এই উক্তিটি ইসমাইল কাদারের ক্ষেত্রেও অনেকটা প্রযোজ্য। কারণ ওনার গদ্য ভাবনাতেও কাব্যিক ঢঙ প্রকাশ পায়। তাঁর কবিতা ‘What are those mountains thinking about’-তে লিখেছেন—

“Women give birth to children,

But a rifle gives birth to firing,

And the two have been equally sacred

To the Albanian:

The firing and the Children.

The child will tomorrow take to the plough

And the rifle will protect him at night.

Time fired shots over the shoulders of Albania

Like rice thrown over the shoulders of a bride.”

কবিতার এই অংশটুকু পড়লেই আমরা তাঁর কাব্যিক ঢঙের সাথে পরিচিত হতে পারি। যেখানে অসাধারণ ভাবে বলেছেন, মহিলারা যেমন সন্তানের জন্ম দেয় তেমনই রাইফেল জন্ম দেয় গুলির। কী অসাধারণ সেই ছবি!

সেই রকমই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের পটভূমিকায় চিত্রিত আলবেনিয়া দেশ, মাঝে মধ্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির খণ্ড চিত্র। ইসমাইল কাদারের প্রথম এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘দ্যা জেনারল অব দি ডেড আর্মি’। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হলেও ইংরাজি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে।

(২)

উপন্যাসের পটভূমি রচিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের কুড়ি বছর পড়ে। বিশ্বযুদ্ধে অর্থ, সম্পত্তি ও প্রযুক্তির ক্ষতি তো হয়েছিলোই কিন্তু সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছিল মায়েদের, সন্তানদের, স্ত্রীদের।

এই কুড়ি বছর ধরে হাজার হাজার মা অপেক্ষা করছেন তাদের সন্তানের ঘরে ফেরার। দীর্ঘ অপেক্ষার ফলস্বরূপ অনেকেই স্মৃতির পাতায় ঝাপসা। আজ হয়তো তাদের সন্তানেরা জীবিত অবস্থায় ফিরে আসবেনা কিন্তু তাদের অবশিষ্ট দেহাবশেষ নিজের হাতে মাতৃভূমির শীতল বুকে ফিরিয়ে দিতে পারলে হয়তো তাদের মনে এক শান্তির প্রলেপ পড়বে। উপন্যাসিক কাদারে কখনও কবি কাদারে হয়ে উঠে কাব্যিক ভঙ্গীতে বলছেন, “Like a proud and solitary bird, you will fly over those silent and tragic mountains in order to wrest our poor young men from their jagged, rocky grip.”

উপন্যাসের পটভূমিতে অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন আলবেনিয়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, আবহাওয়া ও নিসর্গ। উপন্যাসের শুরুতেই তিনি বলছেন, “Rain and Flakes of snow were falling simultaneously on the foreign soil.” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ও কথক একজন ইতালিয় জেনারল। তাকে আলবেনিয়ায় পাঠানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত ইতালিয়ান সৈনিকদের দেহাবশেষ খুঁজেতে। এই কাজে তার সঙ্গে নিযুক্ত হন একজন ধর্ম যাজক যিনি একসময় ইতালিয় সৈন্য দলের কর্নেল ছিলেন।

The bodies of tens of thousands of soldiers buried beneath the earth had been waiting so many long years for his arrival, and now he was here at last, like a new Messiah.

তাঁর বর্ণনায় বলছেন, “নীচের মাটি গহ্বর এবং এবড়ো খেবড়ো ঢাল যেখানে বৃষ্টি পড়ছে, তার তলদেশে শুয়ে আছে আমার দেশের সৈন্যরা”। প্রথম বারের জন্য দ্বিধা ও ভয়ে জেনারেলের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। তিনি যেন উপলব্ধি করতে পারছেন, এই বিদেশে তার কাজ সহজ হবে না। চোখের সামনে দেখছেন সেই মৃত সৈন্যদল; যারা তার নিচে, বিদেশী মাটির নিচে হিমায়িত ও বিধ্বংস হয়ে শুয়ে আছে এবং তাদের এই মাটির তলা থেকে নিদ্রাভঙ্গ করার মিশনেই দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনি। জেনারলের এই মিশনের বর্ণনায় কাদারে বলেছেন, একটি মিশন যা তার গর্ভের অপ্রত্যাশিত ফলাফল বহন করে।

প্রথম কবরের সামনে দাঁড়িয়ে জেনারল লক্ষ্য করছেন টুকরো, গুড়ো গুড়ো মাটিতে তার পা ঢেকে যাচ্ছে, হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে তার কণা। তিনি নিজেকে বলছেন, এই সেই বিদেশী মাটি। কালো কাদা, পাথর, মাটি সবই তো আমার দেশের মতই, Earth like earth everywhere। তবুও এটা বিদেশ।

 (৩)

উপন্যাসের শিরোনাম ‘The General of the dead army’ অর্থাৎ কাদারে জেনারলকে মৃত সৈন্য দলের সেনাপতি বলে অভিহিত করেছেন। এবং উপন্যাসের শেষের দিকে দেখা যাচ্ছে জেনারেলের ভারাক্রান্ত মন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে উঠেছে। তখন তিনি বলছেন, “My army marching by through the roads of Albania. They all are cold & I’m the general of this dead army.”

আলবেনিয়ার মাটিতে পদার্পণের সাথে সাথেই জেনারলের মধ্যে এক অস্বস্তি ও ভয় কাজ করে। কীভাবে এই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি খুঁজে বের করবেন তাঁর দেশের মৃত সৈন্যদের। আলবেনিয়ার আবহাওয়া, পাথুরে মাটি এবং পাহাড়ি উপত্যকা কুড়ি বছর ধরে সংগ্রহে রেখেছে মৃত সৈন্যদের দেহাবশেষ।

“The army was there, below him, outside time, frozen, petrified, covered with earth. It was his mission to draw it up from mud, and the mission made him afraid.”

(৪)

ক্লান্ত, বিষণ্ণ জেনারল তাঁর দল নিয়ে কুড়ি দিন বাদে ফিরে আসেন তিরানার হোটেল দ্যাজতিতে। হোটেলের বাইরে পাইন গাছের সারি, বেসমেন্ট থেকে ভেসে আসছে মৃদু সঙ্গীত। জেনারল ব্র্যান্ডির গ্লাস নিয়ে অন্ধকার লাউঞ্জে এসে বসলেন। নেশাতুর চোখে প্রথম পরিভ্রমণের স্মৃতি ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠতে লাগল। “It tears at my heart when I think of them. I feel like a foster father trying to make it up to children that others have abandoned” ।

অনেক রাতে জেনারল, নিজের ঘরে চেয়ারে বসে আরাম করে সিগারেট ধরালেন। এত ক্লান্তির পরেও একটুও ঘুম নেই চোখে। ব্রিফকেসটা খুলে মৃত সৈন্যের তালিকাটি উঠিয়ে নিলেন, যা তার বহু বার পড়া, আবার পড়তে শুরু করলেন। মৃত সৈন্যের নাম, উচ্চতা, সৈন্য দল, এছাড়াও অন্যান্য বিবরণ সহ দশ পাতার এক সম্পূর্ণ বিবরণী। যেখানে সৈন্যদলের তালিকায় রয়েছে “ওল্ড গ্লোরি রেজিমেন্ট”, “সেকেন্ড ডিভিশন”, “আয়রন ডিভিশন”, “ ৩-য় অ্যালপাইন ব্যাটালিয়ন”, “ ৪-র্থ রেজিমেন্ট অব গার্ডস”, “ভিক্টরি ডিভিশন”, “৭-ম ইনফ্যানট্রি ডিভিশন”, এবং “ব্লু ব্যাটালিয়ন”। এই তালিকার প্রথম নাম কর্নেল জি। কাদারে উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই চরিত্রটিকে অদ্ভুত এক রহস্যের অন্তরালে রেখেছেন। মৃতের তালিকায় কর্নেল জি নাম থাকলেও তার মৃত্যুর কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই, কেউ যেমন তাকে মরতে দেখেনি তেমনি তার জীবন্ত থাকারও কোনও প্রমাণ নেই। ফলে তার মৃত্যু ঘিরে ঘনীভূত হয়েছে এক গাঢ় রহস্য।

জেনারল চেয়ার ছেড়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে কয়েকশ ড্রাম একসাথে বাজছে আর তার তালে ওঠানামা করছে বুক। তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন লাইটের দিকে। মনে পড়ল এমনি এক ঘুম ভাঙা রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটির কথা, সেও ছিল একজন ইতালিয় সৈনিক, আলবেনিয়ায় যুদ্ধ চলাকালীন সে তার এক প্রিয় বন্ধুকে ফেলে এসেছে বিদেশের মাটিতে; যাকে খোঁজার আর্তি নিয়েই তার আসা।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন কারও বৃদ্ধ মা-বাবা, কারও স্ত্রী, কারও ছেলে-মেয়ে, কারও ভাই, কারও বন্ধু একই আর্তি নিয়ে জমায়েত হত তার বাড়ির সামনে। জেনারল ধৈর্য নিয়ে প্রত্যেকের বক্তব্য শুনতেন, এবং সমস্ত দরকারি নথি লিখে নিতেন। আলবেনিয়া আসার শেষ সপ্তাহে দর্শনার্থীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রত্যেকে একই আর্জি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতো তার জন্য। কিন্তু এত ভিড়ের মধ্যেও তিনি দেখতেন একজন বৃদ্ধা প্রতিদিন আসেন কিন্তু কিছু না বলেই চলে যান, জেনারল একদিন তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ছেলে, একমাত্র ছেলে, সে এখনও ওখানে আছে। কাপা কাপা হাতে তিনি তার ছোট্ট ব্যাগ থেকে একটা হলদেটে পুরানো টেলিগ্রাম বের করে জেনারলের হাতে দিলেন, তাতে লেখা, “. . . fell on the field of battle at Stalingrad”। এবং জেনারল যখন তাকে জানায় জায়গাটি রাশিয়ায় তখন বৃদ্ধার মুখ হতাশায় ম্লান হয়ে ওঠে। অবশেষে বলেন, “There is something I want to ask you to do.” “Could you manage to find out where he died, and how? And who was with him, who brought him water, and what his last wishes were?”

(৫)

সৈনিকদের মৃত দেহাবশেষের সাথে জেনারেলের সংগ্রহে আসে তাদের স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ কিছু ডায়েরি। তারই কিছু বর্ণনা করেছেন কাদারে—

পাহাড়ের অলিগলি পথ আগলে এক বৃদ্ধ অপেক্ষা করছেন জেনারলের পথ চেয়ে, জেনারলের গাড়ি তাকে দেখে থামল। বৃদ্ধ একটি কফিন নিয়ে বসে আছেন, তিনি জানান এটি এক আলবেনীয় সৈন্যের মৃতদেহ। এই বেচারা ছেলেটিকে জেনারলের হাতে তুলে দিতেই তার আসা। কারণ, হয়ত ওর জন্য ওর মা বহু অপেক্ষায় বসে আছেন। সৈন্যের পরিচয় জানতে চাইলে বৃদ্ধ বলেন, “We all just called him ‘Soldier’.” দেহাবশেষের সাথে জেনারলের হাতে আসে একটি ডাইরি। এখানেই শুরু হয় অসাধারণ এক গল্প।

“Everyone here calls me ‘Soldier’.” সবাই আমাকে এই নামেই ডাকত, মিলের মালিক, তার স্ত্রী ‘Aunt Frosa’ এবং ক্রিস্টিন্ তাদের একমাত্র মেয়ে। সেই দিন যখন বিপক্ষ সেনা আমাদের হামলা করল, আমার বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে ঠেলে দিল ওই ভয়ঙ্কর জঙ্গলের মধ্যে, ভয়ে পালাতে লাগলাম, দৌড়তে দৌড়তে কখন যেন আবিষ্কার করলাম একটি কিশোরী আলবেনীয় মেয়ে চীৎকার করে বলছে, “Papa! There’s a soldier comming here!” এবং এই ভাবেই একজন সৈনিক থেকে আজ মিলের কর্মচারী। হয়ত আমার পরিবার, বন্ধু এবং সহযোদ্ধারা ভাবছে আমি মরে গেছি!

এই পরিবারের সাথে থাকতে থাকতে কবে যেন এদেরই একজন হয়ে গেলাম। ওরা আমার ভাষা বোঝে না, আমিও বুঝি খুবই অল্প তবুও ওদের সাথে এক আত্মিক অনুভূতি তৈরি হয়েছে। বিশেষত ক্রিস্টিন্; যখনই ও সামনে আসে আমার শূন্য হৃদয় উতলা হয়ে ওঠে। ওর সুন্দর সুরেলা মিঠেল স্বর আমাকে রোমাঞ্চিত করে।

হঠাৎ একদিন অনেক পায়ের আওয়াজ আর চীৎকার শুনতে পেলাম, দেখলাম একদল ইতালীয় সৈন্য। আমি জানিনা,  না পালিয়ে আমিও ভিড়ে গেলাম ওদের দলে, ওরা চীৎকার করে উঠল, “Burn it down, men!” ওরা মিলের দুইজনের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল, মিলের মালিককে বাইরে উঠানের সামনে এনে গুলি করল, আর আন্ট ফ্রোজ্যাকে ওরা হাত পা বেঁধে টানতে টানতে বের করতে লাগল, সে আমার মুখে থুতু ছুঁড়ে দিয়ে চীৎকার করে উঠল, “ Filth! Spy!” কিন্তু আমি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে পাগলের মতো খুঁজে চলেছি ক্রিস্টিনকে। আমি ছুটে গেলাম ওর শোয়ার ঘরে, একটানে ছিঁড়ে ফেললাম পাতলা রাতের পোশাকটা, ও কম্পিত কণ্ঠে চীৎকার করে উঠল, “No! Soldier! No!”

……উফ্! ভাগ্যিস এটা শুধু মাত্র একটা দুঃস্বপ্ন ছিল!

এখন আগস্টের সন্ধ্যে, গত রবিবার ক্রিস্টিনের বিয়ে হয়ে গেল। তার ঠিক দুইদিন আগে আমি ক্রিস্টিনকে আমার পদকটি, ভার্জিন মেরী উপহার দেই, যা আমার পরিচয় বহন করে। এখন আমি মুক্ত।

আজ ৫ই সেপ্টেম্বর গাছের পাতাগুলো হলদে হতে শুরু করেছে, সকালের পরিষ্কার আকাশে অনেক অনেক উঁচু দিয়ে কয়েকশো যুদ্ধ বিমান উড়ে গেল উত্তর-পশ্চিম দিকে। কী জানি আজ পৃথিবীর কোন প্রান্তে এরা বোমা বৃষ্টি করবে !”

এখানেই শেষ হয় এই পলাতক সৈনিকের গল্প। সৈন্যের কফিন জেনারলের হাতে তুলে দিয়ে বৃদ্ধ লোকটি কান্না চাপা গলায় বলে উঠলেন, “No one ever thought to ask him what his name was. Farewell. God be with you on your journey.”

আবার কাদারে বলছেন, “কিছু দূরে আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধু পড়ে আছে, অর্ধেকটা শরীর জলে, দুই হাতদিয়ে বেল্ট ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। হঠাৎ সে ফিস ফিস করে বলে উঠলো, আমি যদি মরে যাই এবং সেই সময় যদি তুমি আমার সাথে থাকো, দয়া করে যতটা গভীর গর্ত করা যায় তত গভীরে আমাকে কবর দেবে। কারণ আমি ওই কুকুর আর শেয়াল গুলোকে খুব ভয় পাই, ওরা যদি আমার শরীরের গন্ধ পায়……! উত্তরে বলেছিলাম, কোন চিন্তা কোরো না, তোমার কবর অনেক, অনেক গভীর হবে। ওরা তোমায় খুঁজে পাবে না…। এবং আমি আমার কথা রেখেছি”।

মর্মান্তিকতার এমনি কিছু উদাহরণ কাদারে তুলে ধরেছেন সাধারণ ভঙ্গীতে। আলবেনীয় সরকার নিয়োজিত একজন বিশেষজ্ঞ এবং চারজন শ্রমিক জেনারলের সহযোগিতায় নিযুক্ত হয়। প্রথম সমাধিক্ষেত্রে বহু প্রতীক্ষার পর মাটির গভীর থেকে বের করে আনা হয় প্রথম সৈন্যের দেহাবশেষ, যেখানে এখনও তার বুক অলংকৃত করছে তার দেশের সৈনিক পদক ‘ভার্জিন মেরী’।

 (৬)

উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জেনারলকে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। তার মধ্যে সবসময় এক দ্বিস্তরীয় স্বত্বা ফুটে ওঠে। জেনারল যখনই একা তখনই তার এই দুই স্বত্বার মধ্যে শুরু হয় ডুয়েল। আবেগ, ভয়, হিংসা, ক্রোধ এই সব ব্যাপারেই দুই স্বত্বার লড়াইয়ের মাঝে জেনারল বন্দী। কাদারে তার উপন্যাসে জেনারেল চরিত্রটিকে কখনও নায়ক, কখনও খলনায়ক আবার কখনও সাধারণ এক মানুষের ভূমিকায় প্রতিস্থাপন করলেও আশ্চর্য এক ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। যেখানে প্রতিটি অবস্থা সহজেই চোখে পড়ে, কিন্তু প্রত্যেকটি যে একটিই চরিত্র সেটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না।

আলবেনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের সমাধিক্ষেত্র, একেরপর এক পিছিয়ে পড়া গ্রাম-মফস্বল, ট্রাকের পিছনে ধুলোয় ঢাকা মৃত সৈন্যদের দেহাবশেষ; জেনারল এগিয়ে চলেছেন তার দেশের শহীদ সৈন্যের মৃতাংশের খোঁজে। তাদের এই খোঁজ সহজ হয়নি, কখনও ভুল তথ্যের কারণে কখনও কালের নিয়মে, কখনও গ্রামবাসীদের কুসংস্কার, বিদ্রোহ কখনও বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। আবার মৃত শরীরের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত শ্রমিকের দল। উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো আবির্ভাব হয় আরেক সমস্যা, জার্মানি দেশের লেফ্টেনন্ট জেনারল। মৃত দেহাবশেষ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাটানিও চোখে পড়ে উপন্যাসের মধ্যে। এত রকমের প্রতিকূলতার মধ্যেও জেনারল খুঁজে চলেছেন তাঁর মৃত সৈন্য দল।

কাদারে এই উপন্যাসে আলবেনিয়ার প্রাচীন গ্রামগুলির যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। গল্পের ভঙ্গিতে দেখানো হয়েছে সংস্কারযুক্ত গ্রামগুলির হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক ছন্দ, বিদেশি সৈন্যদলের উৎপীড়ন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আবার গ্রামের মাঝে হঠাৎ বেশ্যালয় স্থাপন। সবশেষে নিজের স্বামী, পুত্র আঁকড়ে গ্রাম্য মহিলাদের টিকে থাকার লড়াই। উপন্যাসটির আখ্যান যত এগিয়েছে পাল্টে যাচ্ছে চরিত্রগুলি। কোনও এক গ্রাম স্মৃতি বহন করছে ইতালির “ব্লু ব্যাটালিয়ন” সৈন্য দলের। এখানেই এই পুরো দলটিকে তাদের দুর্গের মধ্যে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। স্মৃতি স্বরূপ একটি পাথরে লেখা, “ Here passed the infamous Blue Battalion that burned and massacred this village, killed our women and children, and hanged our men from these poles. To the memory of its dead the people of this place have raised this monument.”

(৭)

“এই বিদেশের মাটিতে আবার বসন্ত ফিরে এল। ঘাস গুলো আবার বড়ো হচ্ছে, কিছু দিনের মধ্যেই পুরো পৃথিবী ঢেকে ফেলবে, পড়ে থাকবে শুধু পায়ে চলা সরু পথ”। জেনারলের মিশন প্রায় শেষ। তবু এখনও তালিকার শীর্ষে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন “Colonel Z”।

উপন্যাসের একটা প্লটে দেখা যাচ্ছে একটি বাড়ির বারান্দায় মুখোমুখি বসে আছেন দু’জনে। জেনারল ও প্রাক্তন কর্নেল। এত দিনের সফরের স্মৃতি, শেষ বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে চলেছেন ক্রমাগত। “Like a tragic and lonely bird . . .” বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টির শব্দের সাথে ভেসে আসছে অচেনা গানের সুর। দূরে কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। গানটা হয়ত সেখান থেকেই আসছে। হঠাৎই জেনারল খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন অনুষ্ঠান বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাদের উপস্থিতিতে এক আতঙ্ক সঞ্চারিত হল আমন্ত্রিতদের মধ্যে। গান থেমে যায়। বাড়ির মালিক তাদের একটি চেয়ারে বসতে সাহায্য করলেন এবং এক পাত্র হুইস্কি এগিয়ে দিলেন। সবাই চুপ। নেশায় মত্ত জেনারল ফিস ফিস করে কর্নেলকে জানালেন সবাই তাদের খুব সম্মান করছে। উত্তরে কর্নেল বললেন, “Death Commands respect everywhere.”

অবশেষে শেষ দিনটি উপস্থিত। মেঘাচ্ছন্ন অলস একটা দিন। দুপুরে হোটেলে প্রেস কনফারেন্স, সকাল থেকেই সাংবাদিকদের ভিড়। মৃত সৈনিকদের আত্মার শান্তি কামানায় আয়োজিত হয়েছে এক অনুষ্ঠান। কিন্তু জেনারল তখনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে ওঠেননি, তিনি যেন শুনতে পাচ্ছেন, “Rain and death, it’s everywhere. A battle between dead men!” তিনি দেখতে পাচ্ছেন, তাঁর মৃতের সৈন্যদল মার্চ করতে করতে এগিয়ে চলেছে।

“Rain mixed with snow was falling on the foreign soil.”

(৮)

কাদারে তাঁর এই উপন্যাসের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির এক নিষ্ঠুর কিন্তু বাস্তব সত্য তুলে ধরেছেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন, মাতৃভূমির জন্য শহিদ সৈন্যদের মৃতদেহ তাদের নিজের দেশে ফিরিয়ে আনতে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় লাগে, কারণ রাজনৈতিক নেতারা ব্যাস্ত সৈন্যদের জীবন নিয়ে রাজনীতি করতে।

কাদারে প্রায় তাঁর সমস্ত ধরনের লেখাতেই নিজের মাতৃভূমির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। বিশেষ ভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক। ‘ব্রোকেন এপ্রিল’ উপন্যাসে তিনি দেখালেন আলবেনিয়ার পাহাড়ি মানুষদের এক পুরনো পরম্পরা ‘মৃত্যুর বদলে মৃত্যু’। এবং ম্যান বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস ‘দি এক্সিডেন্ট’, এখানে দেখাচ্ছেন দুটি মানুষ আর তাদের একটি ট্যাক্সিতে মত্যু ঘিরে রহস্য। অর্থাৎ কাদারে তাঁর লেখায় বারে বারে ফিরিয়ে এনেছেন মৃত্যুকে, বিভিন্ন বাস্তব জীবনের মাধ্যমে।

এই উপন্যাসে কাদারে তাঁর দেশের সৌন্দর্য ও হিংসাত্বক রাজনীতির সুন্দর বর্ণনা করেছেন একজন শিল্পীর মতন। প্রতিটি চরিত্র সৃষ্টিতেও তিনি রেখেছেন সহজাত স্পর্শ। পরবর্তী কালে তার এই উপন্যাসকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে অনেক সিনেমা, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লুসিআনো তোভোলি পরিচালিত ইতালিয় সিনেমা “Il generale dell’armata morta” । দ্য টাইমস বইটি সম্পর্কে লিখেছে, “Literary gold dust – haunting, bleakly comedic and ultimately horrific.” দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কাদারে সম্পর্কে বলেছে, “Mr. Kadare doesn’t do messages; he brings them to lethal life. A peasant gives voice to the dark current that the expedition releases. To bring out the remains of the Italian invaders and their Albanian collaborators is to reinforce the enemy, he complains. Dead soldiers are soldiers.”

সমাপ্ত
সত্যব্রত সিন্‌হা – ‘কৈখালি:সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার’
সত্যব্রত সিন্‌হা – ‘পলাশের খোঁজে : বড়ন্তি’
Close My Cart
Close Wishlist

Close
Navigation
Categories

Add address

India